গত বছরের এই সময়ে করোনা ভাইরাস ধীরে ধীরে পৃথিবীতে ছড়াতে শুরু করে। আর তার এক বছর পর এই সময়ে বিশ্বের নানাপ্রান্তে চলছে এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক গ্রহণ আবার কোথাও চলছে গ্রহণের প্রস্তুতি। তবে এই ভ্যাকসিন কি আপনাকে শতভাগ সুরক্ষা দিতে পারবে আদৌ?
বিশ্ব জুড়ে বহুল প্রতীক্ষিত করোনার ২৭৩টি ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চললেও মোট ১২ টি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গবেষণার তৃতীয় ধাপ পার হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ভ্যাকসিনের ৭০% থেকে ৯৫% কার্যকারিতা লক্ষ করা গেছে। তবে ৯৫% এর বেশি কোনোটিরই কার্যকারিতা এখনো প্রমাণিত হয়নি।
আর তাই বিশেষজ্ঞরা এখনো মনে করছেন, ভ্যাক্সিন প্রয়োগের পরেও মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। আর এক্ষেত্রে মাস্কের বিকল্প কিছুই এখনো ভাবছেন না তারা।
ভ্যাকসিন গ্রহণকারী চিকিৎসক ডা: ইউজেনিয়া সাউথ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ২ টি ডোজ গ্রহণ করার পরেও মাস্ক পরিধানের ব্যাপারে এখনো কঠোর অবস্থানে আছেন।
তিনি মনে করেন, শুধু হাসপাতালেই নয়, বাহিরে বের হলেও মাস্ক পরিধান করা উচিত।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: প্রীতি মালানীর ভাষ্যমতেও উঠে এসেছে মাস্ক পরিধান এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার অনুরোধ। আর তা ততদিনই মেনে চলতে হবে যতদিন না এর বিরুদ্ধে কঠোর এবং কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা না যায়।
মালানীসহ আরও বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে ৫ টি প্রধান কারণে এখনো মাস্ক পরা গুরুত্বপূর্ণ।
১. কোনো প্রতিষেধকই ১০০% কার্যকরী নয়:
মর্ডানা এবং ফাইজার-বায়োনটেকের দুটি ডোজ প্রয়োগের মমাধ্যমে দেখা গেছে ভ্যাকসিন দুইটি ৯৫% এর বেশি সুরক্ষা দিতে সক্ষম নয়। আর তা গবেষণাগারেই প্রমাণিত হয়েছে।
গবেষণাগারের পরিবেশেই যেখানে ৯৫% কার্যকারিতা প্রকাশ পেয়েছে, গবেষণাগারের বাইরের পরিবেশে আদৌ কি সমানভাবে কার্যকারিতা প্রকাশ করতে সক্ষম এই ভ্যাকসিনগুলো?
এছাড়া এমআরএনএ ভ্যাক্সিনগুলোতে ব্যবহৃত জিনগত উপাদানটির অত্যধিক ভঙ্গুরতার কারণে এর সংরক্ষণ ও পরিবহনে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক। কেননা এতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে।
২. ভ্যাকসিন তাৎক্ষণিক সুরক্ষা প্রদান করে না:
সাধারণত ভ্যাকসিন ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করতে দুই সপ্তাহের মত সময় নেয়। কোভিড-১৯ এর মর্ডানা এবং ফাইজারের ভ্যাকসিনগুলোর দুইটি ডোজ যথাক্রমে চার সপ্তাহ এবং তিন সপ্তাহের ব্যবধান রেখে প্রয়োগ করতে হয়।
সেই হিসেবে, সম্পূর্ণ সুরক্ষার জন্য জন্য একজন লোককে অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ থেকে ছয় সপ্তাহ।
অর্থাৎ, ইংরেজি নববর্ষের দিনে ভ্যাক্সিন নেওয়া ব্যক্তি কিন্তু ভ্যালেন্টাইন ডে তে গিয়েও একেবারে সুরক্ষিত নয়।
৩. ভ্যাকসিন আপনাকে ভাইরাস ছড়াতে বাধা দিতে পারে না:
ভ্যাকসিন প্রধানত দুটি স্তরে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। কিছু ভ্যাকসিন আছে যেগুলো ভাইরাসের সংক্রমণের কারণ থেকে রক্ষা করে। ফলে সেই ভ্যাকসিনগুলো গ্রহণকারীর মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানোর কোনো ভয় নেই।যেমন- হামের টিকা।
অন্যদিকে ফ্লু সহ আরও বেশ কিছু ভ্যাকসিন শুধুমাত্র রোগীকে পুনরায় অসুস্থ হওয়া থেকে দূরে রাখে। কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে এদের কোনো ভূমিকাই নেই।
কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন গ্রহণকারী আদৌ ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে কিনা এই বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। তাই টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের আশপাশের লোকদের সুরক্ষার জন্য অবশ্যই নিজেদের মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।
৪. মাস্ক দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন লোকেদের সুরক্ষা দেয়:
একজন ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিশেষ ঝুঁকি রয়েছে।এমনকি এদের মৃত্যুঝুঁকিও অন্যান্য লোকদের তুলনায় অনেকাংশে বেশি।
এছাড়া ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করাটা একটা পর্যায়ে দুঃসহ হয়ে ওঠে। কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের জন্যও ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা খুব কঠিন।
এদিকে গবেষকরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের এই ভ্যাকসিনগুলোতে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দিবে?
তবে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে ধারণা করা হচ্ছে,ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা ভ্যাকসিনের ৯৫% কার্যকারিতার সুবিধা নিতে পারবেন না।
এছাড়া আমেরিকার কেন্দ্রীয় ওষুধ প্রশাসন (সিডিসি) এলার্জিতে ভোগা লোকদের কোভিড-১৯ এর টিকা এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সুতরাং এই সকল লোকেদের একমাত্র সুরক্ষা দিবে মাস্ক পরিধান।
৫. করোনাভাইরাসের যে কোনো স্ট্রেন থেকে রক্ষা করতে পারে মাস্ক:
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য নেতারা করোনাভাইরাসের নতুন জিনগত পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে ভাইরাসটির বেশ কয়েকটি নতুন স্ট্রেনের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেগুলো মূল ভাইরাসের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি সংক্রামক।
যদিও এখন পর্যন্ত ধরে নেওয়া যাচ্ছে এই পর্যন্ত উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনগুলো এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সমানভাবে কার্যকর।
তবে মনে রাখা আবশ্যক যে, পুরোপুরি কার্যকারিতা পাওয়া এখনো সম্ভব হয়নি। টিকা গ্রহণকারীদের ক্ষেত্র প্রতি ২০ জনের মধ্যে ১ জনকে এখনো অনিরাপদ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
আর তাই সকল স্ট্রেনের করোনাভাইরাস, এমনকি শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধেও মাস্ক ব্যবহার এবং সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন।
সর্বোপরি, মহামারীটি নির্মূল করার সর্বোত্তম পন্থা হলো মাস্ক পরিধান, শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব এবং ভ্যাক্সিনেশন। তিনটি পন্থা যখন একটি দল হিসেবে কাজ করবে তখনই এটি সবচেয়ে ভালো কাজ করবে।
ফারিয়া/রিদওয়ান