একদিন পড়ন্ত বিকেলে কুমিল্লার ধর্মসাগর পাড়ে বসে তানিন ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন ভাই হঠাৎ করেই বললেন, রাফি বেশিদিন বাঁচবো না রে! আমি তখন ভাইয়ের কথাকে কিছুটা চাপা হাসিতে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, এইসব আপনার মনের ভুল।’
সেদিনের সেই ভুলকেই যেন সঠিক প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন তানিন মেহেদী। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক প্রাণোচ্ছল তরুণ। ক্যান্সারের কাছে হার মেনে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। স্মৃতি হাতড়ে তাঁর কথাই বলছিলেন তাঁর এক সহপাঠী সারোয়ার রাফি।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রাফি জানালেন, ‘ভাইকে বললাম, একসাথে এখনও বহুদূর যাওয়া বাকি ভাই। এইসব বলিয়েন না ভাই। আমার এমনিতেই বন্ধু সংখ্যা কম, তার উপর আপনি তো আমার ভাই, এসব কী বলেন! ভাই তখন হাসি দিয়ে বললো, তুই বুঝবিনা রে। আমি বুঝতে পারছি আমার মধ্যে কী ঘটছে। যাই হোক, বাদ দে সেসব কথা। খোদাই ভালো জানেন।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন তানিন মেহেদী। প্রথমবর্ষে ক্লাস শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর হাঁটুতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন তিনি।
দৃঢ় মনোবল ও শক্ত মানসিকতার ভীতের ওপর দাড়িঁয়েই টিকে ছিলেন তানিন। ক্যান্সারও তাঁর মনোবলকে এতোটুকু কাবু করতে পারেনি। বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ইয়াসির আরাফাত জানালেন, ‘কখনও ঘাবড়ে যেতে দেখিনি।
চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ও হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষেত্রে কাউকে না পেলে সে একাই চলে যেত। নিজ থেকেই আপডেট জানাইতো। কিন্তু এতো দৃঢ় মনোবল থাকার পরও মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়েছে ওকে। ‘
তানিন খুব করে বেড়াতে চাইতেন। কোথাও থেকে ঘুরে আসার পরিকল্পনা করতেন ঘনিষ্ঠজনদের সাথে। তবে তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হয়ে ওঠেনি। ২০২০ সালে আবারও ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তানিন। হাঁটু থেকে এবার ফুসফুসে।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একই বিভাগের আরেক সাবেক শিক্ষার্থী টুম্পা আফরোজ জানালেন, ‘তানিন মেসেজ দিয়ে একদিন বললো, আপু সুনামগঞ্জে যাওয়ার একটা প্লান করেন। দুই তিন মাসের মাঝে। কে কে যাবে ঠিক করেন। আমরা একদিন হাওড়ে কাটাবো সবাই। তার পরের দিন বাকি জায়গায় ঘুরুম নে ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু এর পরের দিনই মেসেজ দিয়ে বললো, আপু আমি তো সমস্যায় পরে গেলাম। ইন্ডিয়ার যে সমস্যা হইছিলো ফুসফুসে তা আবার হইছে আজকে। দ্রুত হসপিটালে এডমিট হতে হবে।’
এরপর আরেকদিন জিজ্ঞেস করলো, আপনার কাছে যদি একটা হেলিকপ্টার থাকতো তাহলে কোথায় কোথায় যেতেন! আপনার লাইফস্টাইল কেমন হতো? চলেন একদিন কোথাও থেকে ঘুরে আসি কয়েকদিন।
আমি বললাম যেতে তো ইচ্ছে করে রে! ও উত্তর দিল, আরে ইচ্ছে করলে সবই সম্ভব। আমি বললাম তুই এরপর ঢাকা আসলে যাবো নে। ও বলা শুরু করলো, মিথ্যা আশা, মিথ্যা আশা। ইদানিং সবাই এইটাই দেয়। ‘
একদিন তানিন বলতেছে, আপু মানুষ সামান্য কারণেই টেনশন করে অথচ আমি কার কাছে গিয়ে টেনশন করবো! আমি বললাম আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। এরপর বলতেছে, যদি এখনি মৃত্যু এসে যেতো। যদি সমস্ত কাজ স্থবির হয়ে যেতো। যদি সমস্ত অস্থিরতা শিথিল হয়ে যেতো। এক নিমিষেই সমস্ত কিছু থেকে পরিত্রাণ মিলে যেতো!
তানিনকে নিয়ে কিছু বলার বা লেখার সাহস কখনও হয়নি। এটা আমার জন্য কঠিন। আমি এতো কাছের কাউকে হারাইনি। এখনও মনে আছে লাস্ট যেদিন দেখা হয় ও বলেছিলো আপু আমি এই ছোট্ট জীবনে মানুষের যত ভালোবাসা পেয়েছি অনেক মানুষ হাজার বছর বেঁচে থেকেও তা পায় না। আমার এই অসুস্থতা অনেক শারীরিক কষ্ট দিয়েছে ঠিক কিন্তু মানুষের অনেক কাছে নিয়ে গেছে।‘
বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টায় তানিন মেহেদী ছুটে বেরিয়েছেন দেশ বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। ক্যান্সারের কাছে হার মানতেই হলো ২২ বছর বয়সী তানিন মেহেদীকে। ২০২২ সালে ঢাকার ইবনে সিনা হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে পারি জমালেন তরুণ সেই তানিন। রেখে গেলেন অসংখ্য স্মৃতি আর আফসোস।
আফসোস করেই টুম্পা জানালেন, ওঁর সাথে অনেক পরিকল্পনা ছিল। অনেক কিছু করার কথা ছিল। করোনার কারণে হয়ে উঠেনি। এখন মনে হয় সব উপেক্ষা করেও যদি করতে পারতাম। এই আফসোস আর যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে এখন।
সত্যি বলতে, এখন ওঁর লেখাগুলো পড়লে জীবনে বেঁচে থাকার মানে বুঝতে পারি। আমি চাই বিভাগের চিরস্থায়ী যে কোনো একটা কিছুর নাম ওঁর নামে হোক, চাই সবাই ওকে জানুক, ও থেকে যাক আমাদের মাঝেই। সেইটা হতে পারে ছাত্র কল্যাণ তহবিল।
একই সুর ইয়াসির আরাফাতের কথাতেও। তিনি বলেন, ‘মনে আছে আমার কাছে মেহেদীর একটা শেষ ইচ্ছা ছিলো। ও আমার সাথে ঘুরতে যাবে। আমার আর মেহেদীর জন্মদিন পাশাপাশি হওয়ায় একসাথে উদযাপন করতে চেয়েছিল, যেটা আমি পারিনি। ওঁর জন্য একটু সময় বের করতে পারিনি৷
যা আমার সারাজীবনের আক্ষেপ থেকে যাবে। আমি ওঁরে নিয়ে বেশি কিছু লিখতে পারি না, কাউকে বলতেও পারি না। ওঁর সঙ্গে আমার এতো কথা, এতো স্মৃতি যা কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব না। শুধু এটুকু বলতে পারি, ওকে আমি অনেক মিস করি। ‘
আনন্দ সিনেমার শেষ দৃশ্যের একটি সংলাপ প্রায় সকলেরই জানা। বাবুমশাই, জীবন বড় হওয়া জরুরি, লম্বা নয়। যখনই তার সহপাঠী রাফি এই সংলাপের কথা ভাবেন তখন তাঁর মনে হয়, ‘তানিন ভাইয়ের জীবন উনার বয়সের তুলনায় অনেক বড় ছিল। এজন্যই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আর ওই জীবনকে লম্বা করেননি।’
/আসিফ মাহমুদ