MCJ NEWS

‘বয়কট’ শব্দের প্রচলন হয় যেভাবে

ইদানীং ‘বয়কট’ শব্দের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কোনো কিছু পছন্দ না হলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠছে ‘বয়কট’-এর (Boycott) ডাক । ‘বয়কট’- এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে একঘরে করে রাখা বা বর্জন করা। তবে আভিধানিক অর্থের চেয়ে বাংলায় ‘বয়কট’ শব্দের জোরালো অর্থ প্রকাশ পায়। ‘বয়কট’ শব্দটা শুনেনি এই যুগে এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু কিভাবে এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সেটি হয়তো সবারই অজানা। উৎপত্তির পেছনে রয়েছে ইতিহাস ও এক অদ্ভুত রহস্য। চলুন জেনে নেওয়া যাক ‘বয়কট’ শব্দের ইতিহাস ও রহস্য সম্পর্কে।

‘বয়কট’ ছিল একজন ব্যক্তির নাম। যার পুরো নাম ছিল চার্লস কানিংহাম বয়কট (Charles Cunningham Boycott)। চার্লস বয়কট ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিজীবনে চার্লস বয়কট ছিলেন খুবই জেদি ও একগুঁয়ে প্রকৃতির।

চার্লসের প্রথম ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়া। সেই অনুযায়ী ১৮৪৮ সালে তাঁকে ভর্তিও করা হয় উলউইচের ‘রয়্যাল মিলিটারি অ্যাকাডেমি’-তে। কিন্তু কিছু বিশেষ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় অপূর্ণ রয়ে গেল তাঁর সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন।

জীবন বয়ে গেল অন্যদিকে। সমস্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে শুরু করলেন জমি কেনাবেচার কাজ। যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান তিনি। ফলে কিছুদিনের মধ্যে কিনে ফেললেন মায়ো কাউন্টির অন্তর্গত আচিল দ্বীপের বেশ খানিকটা জমি। পাশাপাশি কাজ করতে লাগলেন আয়ারল্যান্ডের আর্ল অফ আর্নের জমি কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে।

১৮৮০ সালে খরার কারণে আয়ারল্যান্ডে শস্য উৎপাদন মারাত্মক রকমের ব্যাহত হয়। ফসল উৎপাদন এত বেশি কমে যায় যে মানুষের জীবনধারণ অনেক কষ্টকর হয়ে উঠে। এমন সময় জমিদারের খাজনা আদায়ের সময় চলে আসে। যেখানে নিজেদের খাবারই জোটে না সেখানে জমিদারের খাজনা পরিশোধ করবে কিভাবে!

তবে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন লর্ড আরনে (মায়ো কাউন্টির জমিদার)। তিনি প্রজাদের খাজনা ১০ শতাংশ মওকুফ করে দিলেন। এরপরও প্রজাদের খাজনা দেওয়ার অবস্থা হলো না।

গরীব প্রজারা আন্দোলন করে বসলো খাজনা কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কমাতে হবে। এবার লর্ড আরনে প্রজাদের এই দাবি মানলেন না। বিদ্রোহী প্রজাদেরকে দমন করার জন্য তাঁর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি চার্লস বয়কটকে পাঠালেন।

চার্লস বয়কট একগুঁয়ে প্রকৃতির হওয়ায় প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা দেখেও তাঁর মন এতটুকু গললো না। তাঁর মনে কেবলই পুরো খাজনা আদায়ের অভিপ্রায়। ধীরে ধীরে তাঁর অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। এমনকি কাজে আসতে সামান্য দেরি হলে, চাষীদের মাইনে কেটে নিতেন চার্লস বয়কট।

কৃষকদের এমন অবস্থায় ত্রাতা হয়ে এলেন চার্লস স্টুয়ার্স পারনেল নামের একজন। তিনি ছিলেন ‘আইরিশ ল্যান্ড’ লীগের একজন সদস্য। তিনি সাধারণ মানুষকে বুদ্ধি দিলেন অত্যাচারী চার্লস বয়কটকে শিক্ষা দিতে হবে, তবে তা অবশ্যই শান্তিপূর্ণ উপায়ে। সোজা কথায় একঘরে করে রাখা হবে। কেউ তাঁর সাথে কথা পর্যন্ত বলবে না।

পারনেলের কথা স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে গেল। তাঁর কথামতো সবাই চার্লস বয়কটকে অবজ্ঞা করতে শুরু করলো। শ্রমিকরা জমির কাজ ছেড়ে দিলো। ব্যবসায়ীরা বয়কটের কাছে পণ্য বেচা বন্ধ করে দিলো। তাঁর চিঠি পৌঁছে দিত না কোনো ডাকপিয়ন। এমনকি বয়কটের বাড়ির কাজের লোকেরাও চলে গেলো কাজ ছেড়ে দিয়ে। সবদিক থেকে এভাবে চাপ সৃষ্টি হওয়ায় বয়কট বেশ ঝামেলাতেই পড়ে গেলো।

তবে সেও দমে যায়নি। বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসলো জমিতে কাজ করার জন্য। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য হাজার খানেক সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করলো চার্লস বয়কট। এই কারণে স্থানীয় কৃষকরা তাঁর উপর আরও চটে গেলো।

তবে এইক্ষেত্রে পারনেল সবাইকে শান্ত থাকতে বললেন। সংঘাতে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে বললেন।

এদিকে বাইরে থেকে আনা এতগুলো লোকের খরচ সামলাতে বয়কটের অবস্থা একেবারেই নাজেহাল হয়ে পড়েছিল। পরের বছরের ফসলের খরচ দিয়ে এদের বেতন ভাতাই হলো না ঠিক মতো। আর্থিক দিক থেকে একেবারে ভেঙে গেলো চার্লস বয়কট।

এদিকে কৃষকরা তাঁকে সামাজিকভাবে বহিষ্কার করেই রাখলো। তাকে এভাবে একঘরে করে রাখার এই কাহিনি তখনকার সব পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকলো।

ভিন্নধর্মী এক আন্দোলনে বেশ সাড়া পড়ে গেলো সমগ্র ব্রিটেনে। কোনো অন্যায় অবিচার মেনে না নিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সামাজিকভাবে বহিষ্কার করে আন্দোলনের ধরণ শুরু হলো সারা বিশ্বেই।

আর এই আন্দোলনকে ডাকা হতে লাগলো ‘বয়কট’ নামে। এভাবেই ‘বয়কট’ শব্দটি ইংরেজি অভিধানে একদিন স্থান করে নেয়।

আই/মরিয়ম আক্তার শিল্পী

শেয়ার করুন -