MCJ NEWS

হেমন্তের স্পর্শে উদ্ভাসিত আনন্দ

“সবুজ পাতার খামের ভেতর

হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে

কোন পাথারের ওপার থেকে

আনল ডেকে হেমন্তকে?”

হীম শীতল শীতের পূর্বাভাস হয়ে হেমন্ত ফিরে আসে বার বার। গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী ও ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে ভরে উঠে চারপাশ। শিশিরভেজা ঘাস চকচক করে উঠে ভোরের আলোয়। সবুজ ধানের মাঠ যখন হলুদ হয়ে উঠে তখন উৎসবের জোয়ার ওঠে চারদিকে। হলদে ধানের ক্ষেত হাওয়ায় ঢেউ খেলে যায় যা বাংলার কৃষি ঐতিহ্যকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে। তারপর শুরু হয় ধান কাটা। ধানের আঁটি নিয়ে যেতে যেতে কৃষাণের কণ্ঠে উৎসারিত হয় ভাওয়াইয়া সঙ্গীত। সেই ছবিটা এই বাংলার, এটা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

২৫শে নভেম্বর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ আয়োজন করে “হেমন্ত উৎসব”। এ বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ছাতিমতলায় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা আয়োজনের মাধ্যমে এই উৎসবের যাত্রা। তবে বর্তমানে অনুষ্ঠানটি বিভাগের সিগনেচার প্রোগ্রামে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর হেমন্তে গ্রামীণ সংস্কৃতির সাজে সেজে উঠে মুক্তমঞ্চ। দিনটিতে বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গ্রাম বাংলার হেমন্ত উৎসবকে তুলে ধরে। বছরব্যাপী শিক্ষার্থীদের মন জুড়ে থাকে হেমন্তের উচ্ছ্বাস। অবশেষে হেমন্ত এলে শিক্ষার্থীদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে আনন্দে।

হেমন্তের উন্মাদনা নিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সুস্মিতা দাস বলেন, হেমন্ত উৎসব এখন পর্যন্ত দুইবার পালন করেছি। প্রতিবারই আমি ভীষণ উপভোগ করেছি। যেহেতু এটাই আমাদের বিভাগ থেকে পাওয়া প্রথম উৎসব ছিলো তাই আগ্রহও ছিল প্রচুর। অপেক্ষায় ছিলাম আরেকটি হেমন্তের। কারণ হেমন্ত এলেই বিভাগে উৎসবের আমেজ শুরু হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শুধু আমাদের বিভাগ থেকেই হেমন্ত উৎসবটি করা হয়। সবাই এক হয়ে এত সুন্দর কাজ করে খুবই ভালো লাগে। একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানের মতো। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উৎসবটি আরও প্রাণবন্ত ও আনন্দমুখর হয়ে উঠে। 

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় প্রতিবছর মুক্তমঞ্চ হলদে কারুকার্যে সেজে উঠে। হলুদাভ ও সবুজ ককশিটের ডিজাইন আধুনিকতা ছাপ যেমন বহন করে হেমন্তকেও ফুটিয়ে তুলে কারুকার্যে। এই সুন্দর আয়োজনের পেছনে থাকে শিক্ষার্থীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা।

উৎসবটি নিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা জাকিয়া জাহান মুক্তা বলেন, এই বিভাগে হেমন্তের যাত্রা হয় একটি ইনফরমাল সেশনের মাধ্যমে। আইডিয়াটি আসে আলী আহসান স্যারের মাথায়। সবাই বর্ষাবরণ, বসন্তবরণ এবং গ্রীষ্মকেও ঢাকঢোল পিটিয়ে বরণ করে। আমরা হেমন্ত বরণ করবো। এই মনোভাব থেকে ছাতিমতলায় মুড়ি আর বাতাসা খেয়ে নাচ, গান, কৌতুকের আড্ডায় হেমন্তের যাত্রা। শুরুর দিকে এটি ছিল মাটির সাথে বন্ধনের একটি বিষয় তবে বর্তমানে হেমন্ত অনেকখানি আধুনিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরপরও গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখার একটা চেষ্টা চলছে। কুলা, ঢেঁকি, হলুদ শাড়ি অর্থাৎ প্রতীকি বস্তু দিয়ে হেমন্তকে তুলে ধরার একটা চেষ্টা থাকে। এটিই একমাত্র প্লাটফর্ম যেখানে আমরা ভেদাভেদ ভুলে একসাথে নাচ-গান করি। হেমন্ত উৎসবে এবারই প্রথম শিক্ষক শিক্ষার্থীরা কোরাস করেছি। রিহার্সাল সেশন গুলোর কারনে এই বন্ধন গুলো আরো দৃঢ় হয়।

যদিও একটি ব্যাচ আয়োজনের দায়িত্বে থাকে তবে সকল ব্যাচের মনোভাব থাকে এটা আমার নয়, আমাদের প্রোগ্রাম।

মাটিতে পাটি বিছিয়ে মুড়ি, বাতাসা খাওয়া ও আড্ডা দেওয়ার কনসেপ্ট থেকে আমরা সরে গিয়েছি। যেহেতু উৎসবটি অনেকটা আধুনিক উৎসবে পরিণত হয়েছে তাই আমরা এখানে কিছু নতুন ইভেন্ট যোগ করতে পারি। যা গ্রাম বাংলাকে আরো ভালোভাবে প্রতিফলিত করবে। মেয়েদের পিঠে তৈরির প্রতিযোগিতা, ছেলেদের ঘুড়ি উড়ানোর কম্পিটিশন, দাড়িয়াবান্ধা, হাডুডু ইত্যাদি। হেমন্তকে আমরা একদিনে আবদ্ধ না রেখে হেমন্ত সপ্তাহ উদযাপন করতে পারি।

হেমন্ত উৎসব কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একটি উজ্জ্বল ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এটি শিক্ষার্থীদের গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার এক চমৎকার উদাহরণ। সময়ের সাথে সাথে উৎসবটি আধুনিকতার ছোঁয়া পেলেও মূল অনুভূতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টায় কোনো ঘাটতি নেই। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই উৎসবকে প্রতিবারই নতুন রূপে, নতুন উচ্ছ্বাসে প্রাণবন্ত করে তোলে। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এবং দীর্ঘ সময় ধরে উদযাপন করার পরিকল্পনা হেমন্ত উৎসবকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের এমন দৃষ্টান্তমূলক চর্চা কেবল আনন্দই নয়, শিক্ষার্থীদের শিকড়ের প্রতি ভালোবাসাকেও গভীরভাবে জাগ্রত করবে।

এআই/ কাজী ফাহমিদা কানন

শেয়ার করুন -