সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এলেও কিছু পরিবর্তন মেনে নিতে মন যেন সায় দেয় না। রমজান মাস এলেই সেই অনুভূতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে- পরিবারের সঙ্গে ইফতার, সেহরি, একসঙ্গে নামাজ পড়ার মুহূর্তগুলো যেন আরও বেশি মনে পড়ে। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে ব্যস্ত শিক্ষার্থীও এই মাসে অন্তত একবার ভাবতে বসে- যদি এখন বাসায় থাকতে পারতাম!
জীবনের তাগিদে পরিবার থেকে দূরে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য রমজান কিছুটা ভিন্নভাবে কাটে। এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী। তাদের গল্পগুলো যেন আমাদের সবার পরিচিত আবেগের প্রতিচ্ছবি। এমন কিছু গল্প এমসিজে নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন কিফায়াত উল হক।
ক্যাম্পাসে ইফতারের অনুভূতি প্রসঙ্গে আইসিটি বিভাগের সজীব বলেন, ‘ইফতারের সময় সবচেয়ে বেশি মিস করি মায়ের বকা!’ কথাটি শুনে একটু অবাক হতেই তিনি হেসে বললেন, ‘ইফতারের সময় কথা বললেই মা বলতেন, ‘চুপ করো, এখন দোয়া করো, এই সময়ের দোয়া কবুল হয়।’
তার কথায় উঠে এলো বাহারি ইফতারের চেয়ে মায়ের বকার গুরুত্ব অনেকটা বেশি।
বন্ধুরা কি পরিবারের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে? এই প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতি বিভাগের রুবাইয়াত অকপটে কিছু স্মৃতিচারণ করলেন। বান্ধবী নিতুর কেক নিয়ে আসা, টিউশনের গার্ডিয়ানের মেয়ের মতো ভালোবেসে সেহরি তৈরি করে পাঠানো- এসব ছোট ছোট ভালোবাসার ছোঁয়া মনে করিয়ে দেয়, যে পৃথিবীতে এখনো অনেক সুন্দর মনের মানুষ রয়েছে।
কিন্তু এসবের পরেও কিছু শূন্যতা তো থেকেই যায়। রুবাইয়াত বলেন, ‘পরিবারের সঙ্গে ইফতার বানানো, একসঙ্গে খাওয়া- এসব মুহূর্তগুলো খুব মিস করি। তবে এখন মানিয়ে নিয়েছি, দুই জায়গায় দু’রকমের সৌন্দর্য। যারা দূরে থেকেও আপন হয়ে ওঠে, তারাই তো প্রকৃত পরিবার।’
আইন বিভাগের আব্দুল্লাহ নোমান পরিবার ও ক্যাম্পাসে রোজার পার্থক্যের বিষয়ে যেন সবার হয়ে বেশ গুছিয়ে জবাব দিলেন। তিনি বলেন, ‘ঘুম থেকে উঠে বন্ধুদের সাথে সেহেরি করে ক্যাম্পাসে রোজা শুরু করি। মসজিদে একসঙ্গে নামাজ পড়া, এবং দিন শেষে প্রিয় বন্ধুদের সাথে দোকানে ছোলা মুড়ির ইফতার- সবই বেশ উপভোগ্য। হাসি, গল্প আর আড্ডায় সময় কেটে যায়। তবে হঠাৎ মনে পড়ে, মা কোথায়? মা-বাবা, ভাই-বোনদের সাথে বসে মায়ের হাতে তৈরি ইফতার তো পাচ্ছি না! এই আনন্দময় পৃথিবীতে কিছুক্ষণ পরেই বিষাদের ছায়া পড়ে।
এমন সময় নিজেকে কীভাবে স্বাভাবিক রাখে জানতে চাইলে তিনি বললেন, তখন বিষাদ ভুলে সার্কেলের আনন্দটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা এখন আমার প্রতিদিনকার অভ্যাস। সময় লেগেছে এই অভ্যাস গড়তে, সময় যাচ্ছে। আরো সময় তো এখানে আমাকে থাকতে হবে!
নোমানের এই অনুভূতি পরিবার থেকে দূরে থাকা কমবেশি সব শিক্ষার্থীর। হয়তো সময়ের সাথে এভাবেই সব সহজ হতে থাকে।
আরেক শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিবও একইভাবে তার অনুভূতি শেয়ার করলেন। রমজানে ব্যস্ততা একটু বেশিই থাকে- ক্লাস, টিউশন, তারাবির নামাজ, পরীক্ষা, সব মিলিয়ে সময়টা বেশ কঠিন। তবে বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে ইফতার করার আনন্দও আছে! তবুও, মনে মনে অপেক্ষা করতে থাকি, কবে ক্লাস শেষ হবে আর বাসায় যাব।
শুধু সাকিবই নয়, এমন অনুভূতি যেন আমাদের সবার। সময়ের সাথে হয়তো আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই, কিন্তু কিছু বিষয় থাকে যা কখনো প্রকাশ পায় না। তবে পরিবার থেকে দূরে থাকলেও, চারপাশের কিছু মানুষ আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর করে তোলে। আর সেই ভালোবাসাই হয়তো পরিবারের দূরত্বের কষ্ট কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়।