নারীত্বের পরিচয়ে নানা প্রতিকূলতা, সমাজের বাঁধা, সময়ের নিষ্ঠুরতা- তবু তারা থামেননি। মিশর, দিল্লি ও ব্রিটেন- তিন ভিন্ন ভূখণ্ডের তিন অসাধারণ নারী, যারা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ় মনোবল ও নেতৃত্বগুণে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাদের সংগ্রাম ও সাফল্য যুগে যুগে নারীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এবং আজও তা আলোকবর্তিকা হয়ে আছে।
বিশ্ব নারী দিবসে ফিরে দেখা যাক সেই তিন মহীয়সী নারীর গৌরবান্বিত ইতিহাস- যারা সময়ের সীমানা পেরিয়ে আজও আমাদের পথপ্রদর্শক।
ফারাও বললে আমাদের চোখে প্রথমে কেমন অবয়ব ভেসে ওঠে? একটু সময় নিয়ে ভাবুন তো! নিশ্চয়ই কোনো বিশালদেহী পুরুষ, কিন্তু না- আজ আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব একজন নারী ফারাওয়ের সঙ্গে, এমন একজন যিনি নিজের নেতৃত্বের গুণাবলীর মাধ্যমে সভ্যতার গোড়া থেকেই মুগ্ধ করে গেছেন। অপরূপ রূপবতী বলে হাতশেপসুতের রূপ আর বুদ্ধির প্রতিযোগিতা করব না। প্রথম তুতমোসের কন্যা হাতশেপসুতের ফারাও হয়ে ওঠার পথ মোটেও সহজ ছিল না। একালের মতো সেকালেও নেতৃত্বের প্রথম বাধা হয়ে উঠেছিল নারী পরিচয়। কিন্তু ভাগ্যের লিখন পরিবর্তন করার সাধ্য কার!
সৎ ভাই তুতমোস (২য়)-এর সঙ্গে বিয়ের পর স্বামী মারা গেলে তৃতীয় তুতমোস অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকায় রাজ্যভার এসে পড়ে হাতশেপসুতের হাতে। আর এই সুযোগে মিশরের ইতিহাসে বিরলতম ঘটনাটি ঘটে। নিজেকে তিনি ঘোষণা করলেন ফারাও হিসেবে। নারী পরিচয়ে নয়, একজন শাসক পরিচয়ে দীর্ঘ ২২ বছর তিনি মিশর শাসন করেন। মিশরে ফারাওদের রাজকীয় পরিচয়ের প্রতীক ছিল দাড়ি। বলা হয়ে থাকে, তিনি নকল দাড়ি পর্যন্ত ব্যবহার করতেন।
স্থাপত্য নির্মাণের মাধ্যমে ইতিহাসে রেখে গেছেন নিজের স্মৃতিচিহ্ন। কার্নাকের রেড চ্যাপেল, বেনি হাসানের পাকহেত মন্দির এবং আসওয়ানে আমুন রেয়ার গৌরবে ওবেলিস্ক নির্মাণসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেন, যার দেয়ালে দেয়ালে এখনো অমর হয়ে আছেন হাতশেপসুত।
পরবর্তীতে তার স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করেন তৃতীয় তুতমোস, এবং ধারণা করা হয়, তাকে খুন করা হয়েছিল। তবে ইতিহাস তাকে অক্ষত রেখেছে। ২০০৭ সালে অবশেষে এক অজ্ঞাতপরিচয় মমির পরিচয় মেলে- সেটা হাতশেপসুতের!
নারী শাসকদের কথা আসবে, আর সুলতান রাজিয়া থাকবেন না- তা কী করে হয়! যার গুণে মুগ্ধ হয়ে মাইকেল মধুসূদন পর্যন্ত কাব্যনাটক লিখে ফেলেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘রিজিয়া: এমপ্রেস অফ ইন্ডিয়া’।
রাজিয়া (১২০৫-৪০) কেবল ইলতুৎমিশের আদরের কন্যা ছিলেন না, বরং একজন যোগ্য শাসক হওয়ার যোগ্যতাও ছিল তার। তাই মৃত্যুর আগে পরবর্তী সুলতান হিসেবে রাজিয়াকে মনোনীত করেছিলেন ইলতুৎমিশ। কিন্তু যুগের সেই একই কাহিনি! পারিবারিক ষড়যন্ত্রের শিকার হন তিনি, এবং সিংহাসনে বসেন তার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা রুকুনুদ্দীন। কিন্তু মদের নেশা, বিলাসিতা ও অদক্ষতার কারণে প্রশাসন ও জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে মাসখানেকের মধ্যেই রাজিয়া সিংহাসনে আসীন হন।
১২৩৬-১২৪০ এই চার বছর অসংখ্য বিরোধী আমলাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি যেভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন, তা প্রশংসাযোগ্য। তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, তুখোড় রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ও যুদ্ধজ্ঞান সবকিছু মিলিয়ে তাকে শাসনে টিকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আর কতদিন পারা যায়? অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মুখে ১২৪০ সালে আলতুনিয়া নামে এক প্রভাবশালী গভর্নরের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পরাজিত হন। বন্দি অবস্থায় আলতুনিয়াকে বিয়ে করলেও দিল্লির সিংহাসন হারান। পরে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালালে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে নিহত হন। নারী হওয়ায় নানান বাধার মুখে পড়লেও তিনি ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক হিসেবে নিজের নাম লিখে গেছেন ইতিহাসের পাতায়। যেখানে আছে তার সাহস, দৃঢ়তা, বিচক্ষণতার ইতিহাস।
আপনাকে যদি কেউ বলে আপনি একজন ‘লোহা মানব’, আপনি কীভাবে নেবেন? ভালো না মন্দ? ইতিহাসে ‘আইরন লেডি’ খ্যাত মার্গারেট থ্যাচার কিন্তু সমালোচনার ছাপ নিয়ে আসা এই নাম সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭৬ সালে, যখন মার্গারেট ব্রিটেনের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন এবং সোভিয়েতের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আওয়াজ তুলছিলেন, তখন সোভিয়েত সাময়িকী রেড স্টার তাকে ‘আইরন লেডি’ বলে অভিহিত করে। সমালোচনার এই নামটি তিনি নিজের ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেন।
লিংকনশায়ারের ছোট শহর গ্রান্থামে জন্ম নেওয়া থ্যাচার যে একদিন ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল?
বিজ্ঞানপ্রেমী মার্গারেট অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সোমারভিল কলেজে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ডরোথি হজকিনের অধীনে গবেষণাও করেন। আবার তিনিই ১৯৭৯ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন! রাজনৈতিক দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা দিয়ে তিনি ব্রিটেনের সেই সময়কার কঠিন সব পরিস্থিতি সামলান।
যেই সময় ব্রিটেনের অর্থনীতির বেহাল দশা ছিল, তখনই আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে ক্ষমতায় আসেন মার্গারেট থ্যাচার। অর্থনীতিতে তিনি চালু করেন মুক্তবাজারনীতি। তার সংস্কারগুলো আজও ‘থ্যাচারিজম’ নামে সমাদৃত।
এই দূরদর্শী, বিচক্ষণ এবং একই সঙ্গে বিতর্কিত নারী ১৯৯০ সালে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ২০১৩ সালে তেজস্বী মার্গারেট থ্যাচার মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাসের গভীরে এমন অসংখ্য নারী রয়েছেন, যারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, অথচ তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। কিন্তু তাদের গল্পগুলো কোনো অংশে কম অসামান্য নয়। প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তারা এগিয়ে চলেছেন- নতুন ইতিহাস গড়ার পথে।
/ কিফায়াত উল হক