আজ ৮ই মার্চ, প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছরের নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। দীর্ঘ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী জমকালো আয়োজনে নারী দিবস উদযাপিত হলেও, প্রশ্ন উঠছে- নারীর অবস্থান আসলে কোথায়, সমাজে?
নারীর সাথে জড়িয়ে আছে নিরাপত্তা, নেতৃত্ব, ক্ষমতায়ন এবং সমধিকার। কিন্তু যদি একটু লক্ষ্য করি, দেখা যায় যে নারী এখনও চরম নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেন। লাঞ্চনা, বঞ্চনা এগুলো আমাদের সমাজে নারীর সঙ্গেই অধিক পরিচিত। সমানাধিকারের কথা বললেও, প্রতিটি পদে তাদের পিছিয়ে রাখার অনেক গল্প রয়েছে।
নারী দিবসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের কথা শোনা যাক- তাদের দৃষ্টিতে কীভাবে চলছে বর্তমান পরিস্থিতি?
বাংলাদেশে নারীদের উন্নতি দৃশ্যমান হলেও নিরাপত্তা ও ন্যায্য সুযোগের অভাবে তারা এখনো শোষিত এবং ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দরিদ্র নারীরা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন এবং অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হন। নারীর নিরাপত্তার অবস্থা বোঝার জন্য সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই যথেষ্ট। যেমন, ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নারী শিক্ষার্থী হেনস্তার শিকার হন, কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়ে সংবর্ধিত হন। ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে, যা নারীদের চলাফেরাকে আতঙ্কে পরিণত করেছে। ৮ মার্চ নারী দিবসে সম্মান দেখানো হলেও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। একদিন নারী দিবস উদযাপন করলেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না; তাদের সুরক্ষা ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে, নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিতে নারীদের নেতৃত্ব আশা জাগায়, যা ভবিষ্যতে নারীর অধিকার সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।
– মনিরা রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নারী হলো সৃষ্টির প্রতীক, যার অস্তিত্ব ছাড়া সৃষ্টির কল্পনা করা যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে। তবে, সমাজে একদিকে উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে। সমাজের এক বড় অংশ নারীকে দুর্বল হিসেবে দেখে এবং তার অধিকার ও মর্যাদাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেনা। ২০২৪ সালে যৌতুকের দাবিতে ৩৬ জন নারী হত্যার শিকার হন। ২০২৪ সালে, ২২৪টি কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়, যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের নারীদের সঠিক সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে তারা দেশ গঠনে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে। প্রথমত, আইনি কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং ধর্ষকদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি, অর্থাৎ ফাঁসি, নিশ্চিত করতে হবে।
– জান্নাতুল মাওয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনও কম। ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩% নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কোটা পূর্ণ হয়নি। দেশে সাবেক দুই নারী প্রধানমন্ত্রী থাকলেও, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়নি। যদিও প্রধানমন্ত্রীদের একজনের রাজনীতিতে প্রবেশ বাবার, অন্যজনের স্বামীর মাধ্যমে সহজ হয়েছিল, তবুও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে নেতৃত্ব পর্যায়ে পৌঁছানো কোনো নারী আজও বাংলাদেশে কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।
ছাত্র রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণও কম। রাজনীতিতে জড়িত নারীরা নানা ট্যাগিং, ব্লেমিং এবং সামাজিক স্টেরিওটাইপের শিকার হন। নারীরা রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। তবে, দেশের যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নারীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এই দেশে হাজার হাজার নারী সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা জীবন ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তবুও, নারীদের দেশের রাজনীতিতে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। সর্বস্তরে নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করা এখন শুধু সময়ের দাবি।
– আইরিন রিয়া, জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
নারী দিবস উদযাপন নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দিনটি নারীর অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়নের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি সুযোগ তৈরি করে। গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নারীদের অর্জন ও সমস্যা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে। তবে, এটি শুধুমাত্র একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বছরের প্রতিটি দিন নারীর প্রতি সম্মান ও সমতার চর্চা করা উচিত। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে সমাজের সব স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি।
– ঋক্তা চক্রবর্তী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
/কাজী ফাহমিদা কানন, কিফায়াত উল হক