MCJ NEWS

হাল্ট প্রাইজ কুবি: উদ্ভাবনী তারুণ্যের বিশ্ব পরিবর্তনের স্বপ্ন

কিফায়াত উল হক

হাল্ট প্রাইজকে বলা হয় ‘শিক্ষার্থীদের নোবেল’, যেখানে তরুণ উদ্ভাবকরা শুধু শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য নয়, বরং বিশ্ব পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে এক মিলিয়ন ডলারের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেই ধারাবাহিকতায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় হাল্ট প্রাইজ কুবি।

শিক্ষার্থীরা তাদের সৃজনশীল আইডিয়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, যেখানে সেরা সাতটি টিম ফাইনালে জায়গা করে নেয়। এই আইডিয়াগুলো শুধুমাত্র প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন নয়, বরং এমন চিন্তা যা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। প্রতিযোগিতাটি ছিল মেধা, সৃজনশীলতা এবং নতুন চিন্তার উদাহরণ। এমসিজে নিউজের পাঠকদের জন্য তাদের সেই সব আইডিয়া তুলে ধরা হলো, যা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে!

টিম ডাল-ভাতের বর্জ্য থেকে অর্থ:
আপনার রান্নাঘরের ফেলে দেওয়া বর্জ্য একদিন হতে পারে আয়ের উৎস-এমন ভাবনা নিয়েই হাজির হয়েছে টিম ডাল-ভাত। হাল্ট প্রাইজ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৫-এর প্রতিযোগিতায় এই দলটির লক্ষ্য হলো বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে নতুন পণ্য তৈরি করা, কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা এবং সেই সঙ্গে একটি অ্যাপভিত্তিক ডিজিটাল সমাধান প্রদান করা। তাদের অ্যাপে ব্যবহারকারীরা রিসাইকেল করা পণ্য বিক্রি করতে পারবেন এবং ট্র্যাশ জমা দিয়ে অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করতে পারবেন, যা পরবর্তীতে নতুন পণ্য কেনার কাজে ব্যবহার হবে। এভাবে, ডাল-ভাত তাদের উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে সাস্টেইনেবল অর্থনৈতিক মডেল গড়তে চায়, যেখানে বর্জ্যই হয়ে উঠবে আয়ের উৎস।

ভিশনারি মার্কেটারসের দূরদর্শীতা:
টিন, টাইলস ও পলিথিনের প্রচলিত ব্যবহার কমাতে টিম ভিশনারি মার্কেটারস কলাগাছের ফাইবার থেকে টেকসই নির্মাণ উপকরণ তৈরি করার পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। প্রচলিত টিন ও টাইলস যেগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, সেখানে তাদের উদ্ভাবন দীর্ঘমেয়াদি, সাশ্রয়ী ও ইকো-ফ্রেন্ডলি সমাধান এনে দেবে।

তালের সুগন্ধ ছড়িয়েছে টিম অ্যারোমা:
প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ তাল নষ্ট হয়। অথচ, এই তাল থেকেই তৈরি হতে পারে জেলি, স্ক্রাব, লোফা। টিম অ্যারোমা তালের এমন ব্যবহারই দেখিয়েছে। তালের আঁশ ও বীজ, যা সাধারণত অবহেলিত, তা দিয়েই তারা তৈরি করছে নতুন নতুন পণ্য। তারা দেখিয়েছে, তাল কেবল রসের জন্যই নয়, বরং সম্পূর্ণ ফলটিকেই কাজে লাগিয়ে ‘জিরো ওয়েস্ট’ করা সম্ভব। তাদের পরিকল্পনায় তাল দিয়ে ক্রাফট আইটেম তৈরি করার ভাবনাও রয়েছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারেও নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

স্লিদারিনের গ্রীন ম্যাজিক:
কলার ছাল থেকে ইকো-পলিথিন। পরিবেশের ‘ভল্ডেমর্ট’ নামক প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে টিম স্লিদারিন তুলে ধরেছে এক বিকল্প। কলাগাছের ফাইবার থেকে তৈরি ইকো-ফ্রেন্ডলি পলিথিন হবে মাটিতে সহজে মিশে যাওয়ার মতো, যা জলজ উদ্ভিদ রক্ষা করবে, গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঠিক রাখবে এবং মাটি দূষিত করবে না। এটি নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করবে, যেখানে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী কলাগাছের পরিত্যক্ত অংশ ব্যবহার করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ পাবে।

ভিশনারিদের নারিকেল বিপ্লব:
নারিকেলের মালা, ছোবড়া-যা এতদিন ফেলনা ছিল, তা দিয়েই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে টিম ভিশনারি। তাদের লক্ষ্য পরিবেশবান্ধব ম্যাট, স্ক্রাবার, আর্টিফিশিয়াল হাউজ ডেকর তৈরি করা, যা প্লাস্টিক, কাঁচ ও চাটের ব্যবহার কমাবে। তারা চান স্থায়িত্বশীল পণ্য তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ কুটির শিল্পের প্রসার ঘটাতে, যেখানে নারিকেলের খোসা থেকেও টেকসই উপকরণ তৈরি হবে।

শতরঞ্জির নতুন বুনন:
গার্মেন্টস শিল্পের বিপুল বর্জ্য নিয়ে যখন সবাই চিন্তিত, তখন টিম শতরঞ্জি তা দিয়েই এক নতুন সম্ভাবনার গল্প লিখেছে। পিভিসি বোর্ডের ক্ষতিকর বিকল্প হিসেবে তারা এনেছে ‘ফ্যাব বোর্ড’-যা ফেব্রিক থেকে তৈরি হওয়ায় সহজেই প্রকৃতিতে মিশে যাবে। কম দামে, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পণ্যের হাতছানি নিয়ে এই বোর্ড প্রথমে খুচরা বাজারে লঞ্চ করা হবে, তারপর বড় কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে আরও বিস্তৃত করা হবে।

বারোমাসি কলার গুণকীর্তন:
সহজলভ্য কলা যে হেলাফেলা করার নয়,তা দেখিয়েছে টিম গ্লো লিফ। গ্লো লিফ কলার গুণাগুণকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে! তারা এমন ভেগান স্কিন কেয়ার ও প্রোটিন পাউডার এনেছে, যেখানে কোনো অংশই অপচয় হবে না। ময়েশ্চারাইজার, অ্যান্টি-এজিং, ব্রাইটনিং পণ্য তৈরি হবে কলা থেকে। এমনকি কলার খোসা ব্যবহার হবে প্রোটিন পাউডার তৈরিতে। এই প্রক্রিয়া ক্যামিক্যালযুক্ত প্রসাধনীর বিকল্প দেবে এবং বাজারে একটি ন্যাচারাল, টেকসই, ওয়েস্ট-ফ্রি ব্র্যান্ড গড়ে তুলবে।

টিম ডালভাতের লিডার রিয়াদ হোসাইন বলেন, ‘গত বছর রানারআপ হওয়াটা আমাদের জন্য একটু কষ্টের ছিল, কিন্তু সেখান থেকেই জয়ের স্পৃহা এসেছে। এবার শুরু থেকেই আমি আইডিয়ায় মনোযোগ দিয়েছি এবং সেটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। আলহামদুলিল্লাহ্, আজ আমরা চ্যাম্পিয়ন! এই আনন্দ সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমার টিম দুর্দান্ত কাজ করেছে, আর আমি ওদের নিয়ে ভীষণ গর্বিত।’

শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা চেতনা দেখে ফাইনালে অতিথি হিসেবে উপস্থিত প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কর্পোরেট ব্র্যান্ড ম্যানেজার শেখ হামিম আলী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের আইডিয়া ও প্রতিভার প্রশংসা করেন। তিনি জানান, প্রতিযোগীদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি এবং আয়োজকদের পরিকল্পনা বেশ ভালো লেগেছে।

তিনি বলেন, ‘আমি মুগ্ধ, এমনকি প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে কাউকে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে নিয়োগ দেওয়ার কথাও ভাবতে পারি।’

বর্তমান বিশ্বে সাসটেইনেবিলিটির গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি জানান, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপও এ বিষয়ে কাজ করছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠার পাশাপাশি খরচও কমানো হচ্ছে। ভবিষ্যতে যারা সাসটেইনেবিলিটি নিয়ে গবেষণা করবেন, তারা ভালো ফলাফল পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

শেয়ার করুন -