আমন্ত্রণ আর অভয়ের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেরিয়ে একটু ডানে এগোলেই প্রশাসনিক ভবন। ফটক থেকে ভবনটির দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ঘন সবুজ পাতার অতিকায় একটি তালসদৃশ গাছ। সরল গড়নের বিশালাকৃতির পাতার এই গাছটি প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক কাজের তাড়ায় ছোটা মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তবে যারা সবুজ ভালবাসেন, বৃক্ষের বিশালত্বে বিস্মিত হন, প্রকৃতির নানারূপের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন তারা গাছটি দেখলে দু দন্ড এর ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিস্ময় প্রকাশ করবেনই। গাছটি বিরল প্রজাতির তালিপাম। কিন্তু কোন নাম বা পরিচিতিমূলক কোন ফলক না থাকায় গাছটি সম্পর্কে জানার সুযোগ সকলের হয় না।
শতবর্ষে একবার ফুল দেওয়া তালিপাম গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Corypha taliera। এই তালিপামের প্রথম সন্ধান মেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের ভবনের সামনের বুনো প্রজাতির একটি গাছ থেকে। এই গাছটিকে ২০০১ সালে পৃথিবীর একমাত্র তালিপাম গাছ হিসেবে চিহ্নিত করেন বাংলাদেশের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা। ২০০৮ সালে গাছটিতে প্রথম ফুল আসে এবং ২০১০ সালে ফল দিয়ে গাছটি মারা যায়।
তবে সরকারি বাংলা কলেজের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক আখতারুজ্জামান চৌধুরী সেই গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে এবং ওই ফল থেকেই চারা তৈরি করেন। শেষ পর্যন্ত চারার সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচশ। এর মধ্যে বেঁচে যাওয়া তিনশ চারা বণ্টন করা হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া হয় সাতটি চারা।
বিশ্ববিদ্যালয়টির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমির হোসেন খান চারাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে রোপন করেন। অযত্ন ও অবহেলায় এই সাতটি গাছের ছয়টিই মারা গেছে। কেবল বেঁচে আছে প্রশাসনিক ভবনের সামনে নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকা এই গাছটি।
তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিরল প্রজাতির এই গাছটি সম্পর্কে অনেকে কিছুই জানে না আবার তাল গাছ ভেবে ভুল করে কেউ কেউ।
গাছটি সম্পর্কে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শারমিন সুলতানা বলেন, মাঝেমধ্যেই প্রশাসনিক ভবনের দিকে যাওয়ার সময় গাছটি চোখে পড়তো। কিন্তু তাল গাছের মতো দেখতে এই গাছটি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিলো না। সাথে থাকা বন্ধুকেও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করি গাছটি নিয়ে।সেও না জানায় পরবর্তীতে আর জানার আগ্রহ হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, তালিপাম গাছটি সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না এবং গাছটির নাম যে তালিপাম, আমি এটাও জানতাম না। প্রশাসনিক ভবনে যাওয়ার সময় গাছটি অনেক চোখে পড়েছে কিন্তু কখনো ভাবা হয়নি এটি কী গাছ? তবে মনে হতো যে এটি তাল গাছ জাতীয় কোনো গাছ হবে। আর সামনে বাইক বা গাড়ি থাকার কারণে অনেকেরই হয়তো গাছটি নজরে পড়ে না ঠিকমতো।
পৃথিবীতে বিরল এই উদ্ভিদটির আকর্ষনীয় বিষয় হলো এর পুষ্পবিন্যাস বা ফুলের গঠন বিশ্বের যে কোনো উদ্ভিদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, যা ৮ মিটার (২৬ ফুট) পর্যন্ত লম্বা এবং লক্ষ লক্ষ ছোট ফুল এটি ধারন করতে পারে।
এর চিত্তাকর্ষক আকার আর অনন্য প্রজনন ক্ষমতা ছাড়াও ঐতিহ্যগত ঔষধ এবং সংস্কৃতিতে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। ঘরের ছাউনি দেওয়া এবং মাদুর বা চাটাই বানানোর কাজে তালিপাম এর পাতা ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এর রস ব্যবহার করা হয় অ্যারাক নামক এক ধরনের অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় তৈরিতে। আয়ুর্বেদিক ঔষধ, জ্বর এবং আমাশয় এর চিকিৎসায় ও তালিপামের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়।
সারা বিশ্ব জুড়েই বিরল এমন এক উদ্ভিদের আবাসস্থল যেহেতু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশ সচেতন শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, গাছটির যেন সঠিক যত্ন নেওয়া হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন গাছটি সম্পর্কে আরও জানতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভরায়ণ্যের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাফায়িত মুমিন সিফাত বলেন, তালি পামের মতো বিরল একটি উদ্ভিদ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলেও অনেকেই সেটা জানে না। এর জন্য প্রচারণা যেমন প্রয়োজন তেমনি সংরক্ষণ নিশ্চিত করাও জরুরী। কারণ ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭টি গাছ রোপণ করা হলেও টিকে আছে মাত্র একটি। মূলত বুনো তালি পাম গাছ এক-দেড়শ বছর বেঁচে থাকার পর ফুল-ফল দিয়েই মারা যায়। এই গাছ সম্পর্কে যদি সচেতন থাকে, তাহলে কোনো এক কালে ফল আসলে তা থেকে নতুন চারা উৎপাদনও সম্ভব হবে।
/আসিফ মাহমুদ