তরমুজ—গ্রীষ্মকালের প্রিয় এক ফল। গ্রীষ্মের দাবদাহে এটি এনে দেয় একটুখানি স্বস্তি। বাইরের সবুজ আবরণে ভেতরটা টুকটুকে লাল যেন সবুজের বুকে শহীদের রক্তের বুদ্বুদ।
তবে অবাক করার বিষয়, এই তরমুজই এক সময় হয়ে ওঠে নিপীড়িত ফিলিস্তিনের পতাকা। হ্যাঁ, যাকে আমরা শুধুই ঠান্ডা, মিষ্টি এক ফল মনে করি, সেই এক খণ্ড তরমুজ স্বাধীন ফিলিস্তিনের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি।
তাহলে কিভাবে তরমুজ একটি জাতির স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠল? এবার জানা যাক সেই গল্প।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল যখন পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে, তখন ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকার প্রকাশ্যে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে ইসরায়েলি সরকার। এই কঠোর নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ফিলিস্তিনিরা বেছে নেয় ভিন্ন এক পথ—তাদের চার রঙের পতাকার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় তরমুজের। কারণ, কাটা তরমুজের মধ্যে থাকে লাল, সাদা, কালো ও সবুজ রঙের উপস্থিতি, যা ফিলিস্তিনের পতাকার রঙের সাথে হুবহু মিলে যায়।
শুধু পতাকাই নয়, ইসরায়েলি দমনযন্ত্র এতটাই চূড়ান্ত ছিল যে ১৯৮০ সালে রামাল্লার ৭৯ গ্যালারিতে স্লিমান মানসুর, নাবিল আনানি, ইসাম বদরুলসহ শিল্পীদের চিত্রপ্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনের পতাকার রঙ ব্যবহারের অভিযোগে চিত্রশিল্পীদের হুমকি দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে একজন শিল্পী মজা করে বলেন, তাহলে আমি যদি এই চার রঙে একটা ফুল আঁকি? ইসরায়েলি কর্মকর্তার জবাব ছিল, তাও নিষিদ্ধ হবে। এমনকি তরমুজ আঁকাও তখন অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। এক পর্যায়ে গাজায় কাটা তরমুজ হাতে নিয়ে রাস্তায় হাঁটার অপরাধে যুবকদের গ্রেপ্তার করা হয়। ততদিনে তরমুজ হয়ে উঠেছে এক ধরনের ‘নীরব প্রতিরোধ’।
১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ স্বীকৃতি পেলেও সংগ্রাম থেমে থাকেনি। সেই সময় জেরুজালেমে এক বিক্ষোভে প্রতিবাদকারীরা ফিলিস্তিনি পতাকার রঙে আঁকা তরমুজ হাতে তুলে নেন, যেখানে লেখা ছিল ‘স্বাধীনতা’। তেল আবিবের রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের টি-শার্টেও দেখা যায় তরমুজের প্রতীক। এ বিষয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক জন কিফনার তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, “এ সময় ইসরায়েলি সৈন্যরা মিছিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। কেউ যদি ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়াত, তারা সেটি কেড়ে নিত।”
২০০৭ সালে শিল্পী খালেদ হুরিনি ‘সাবজেক্টিভ অ্যাটলাস অব প্যালেস্টাইন’-এ “স্টোরি অফ দ্য ওয়াটারমেলন” নামে একটি শিল্পকর্ম তৈরি করেন, যা পরে ‘দ্য কালারস অফ দ্য প্যালেসটিনিন ফ্লাগ’ নামে পরিচিতি পায়। এরপর থেকেই বিশ্বব্যাপী তরমুজের এই প্রতীকী ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।
২০২১ সালে শেখ জাররাহ ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদের নতুন ঢেউ ওঠে। সেই সময় সামাজিক মাধ্যমে ও রাস্তায় তরমুজ আবার ফিলিস্তিনের প্রতীকে পরিণত হয়। চিত্রশিল্প, দেয়ালচিত্র, কবিতা ও পোস্টার সর্বত্র উঠে আসে তরমুজের প্রতীকী ব্যবহার। এমনকি তরমুজ হয়ে ওঠে সামাজিক মাধ্যমে মত প্রকাশের একটি বিকল্প ভাষা। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিলিস্তিনপন্থী পোস্ট বা প্রতীক প্রদর্শনের কারণে অনেক ব্যবহারকারী ‘শ্যাডো ব্যানিং’-এর শিকার হন। এই ‘শ্যাডো ব্যানিং’ অর্থাৎ কোনো ব্যবহারকারীর পোস্ট তার অজান্তেই মুছে ফেলা হয়। ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ফেসবুকসহ বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মেই এমন ঘটনা ঘটেছে। গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায়, ইসরায়েল বারবার বাকস্বাধীনতা হরণের আয়োজন করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের কণ্ঠে প্রতিরোধের ভাষা যেন তাদের কাছে অপরাধ।
তবুও থেমে যায়নি প্রতিবাদ। তরমুজ রয়ে গেছে এক প্রতীকী অস্ত্র হয়ে। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে চিত্রকর্ম সবখানেই তরমুজ বলছে ফিলিস্তিনের কথা। কারণ, তরমুজ এখন শুধু একটি ফল নয়, এটি এক পতাকার রূপ, এক জাতির স্বপ্ন, এবং এক অদম্য লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি।
/মারুফ শেখ