বই এক যাদুর নাম। যে মশালের আলোয় মনের অন্ধকার দূর হয়, জীবনের পথ জ্বলজ্বল করে ওঠে। কেউ বই কিনে কখনো দেউলিয়া হয় না, বরং হয় সমৃদ্ধ। যেমন একটি গাছ সামান্য যত্ন পেলে অকৃপণভাবে ফল দেয়, তেমনই বইও পাঠকের মন-মানসে আলো ছড়ায়, বদলে দেয় দৃষ্টিভঙ্গি, খুলে দেয় চিন্তার জানালা।
বই যেন এমন এক গাড়ি, যার না আছে চাকা, না আছে ইঞ্জিন, তবুও ছুটে চলে সীমাহীন গন্তব্যে। কখনো ফিরিয়ে নিয়ে যায় ইতিহাসের ধুলোমাখা পাতায়, আবার কখনো বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের পেছনের রহস্যে। কখনো তুলে ধরে সমাজের বাস্তবতা, আবার কখনো জন্ম দেয় নিঃশব্দ প্রতিবাদের শক্তি।
বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণের সূচনা বহু পুরনো। একসময় মানুষ উচ্চস্বরে বই পড়ত, যাতে নিজে যেমন বোঝে, পাশের জনও শুনে শেখে। তখন বই পড়া ছিল এক সামাজিক অভ্যাস। কিন্তু সময় বদলাতে থাকে। চতুর্থ শতকে একদিন দেখা গেল, সেন্ট অ্যামব্রোস বই পড়ছেন নিঃশব্দে, শুধু চোখে দেখে। উচ্চারণ নয়, ভাবনার ভেতর দিয়ে তিনি খুঁজে নিচ্ছেন অর্থ। সেন্ট অগাস্টিন তখন বিস্ময়ভরে লিখেছিলেন এই অভাবনীয় দৃশ্যের কথা। এখান থেকেই শুরু হয় নীরব পাঠের যাত্রা, যেখানে পাঠক একা, কিন্তু ভেতরে জেগে ওঠে শব্দহীন কথোপকথন। এরপর আসে ছাপাখানার আবিষ্কার, যা বইকে সাধারণ মানুষের নাগালে পৌঁছে দেয়। শিল্পবিপ্লবও বইয়ের প্রসারে নতুন গতি আনে। বই হয়ে ওঠে নিত্যদিনের সঙ্গী, চিন্তার রসদ, সময়ের দলিল।
বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ও মূল্যবোধ বাড়াতে ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো ২৩ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব বই দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই তারিখটি বেছে নেওয়ার পেছনে রয়েছে এক অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক মিল। এই দিনেই প্রয়াত হয়েছিলেন বিশ্বসাহিত্যের তিন দিকপাল: মিগুয়েল দে সেরভান্তেস, উইলিয়াম শেক্সপিয়র এবং গারসিলাসো দে লা ভেগা। একইসাথে স্পেনের ক্যাটালোনিয়া অঞ্চলে এই দিনটি বহু আগে থেকেই ‘সেন্ট জর্জ’ দিবস হিসেবে পালিত হয়, যেখানে প্রিয়জনকে বই ও ফুল উপহার দেওয়া হয়। এসব ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে সম্মান জানিয়ে এই দিনটিকে বিশ্ব বই দিবস ঘোষণা করা হয়, যাতে বইয়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ লেখক জয়েন উদ্দিন সরকার তন্ময়ের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা শুরু হয়েছিল শৈশবেই। শরৎচন্দ্র পড়তে পড়তে তিনি ‘পথের পাঁচালির’ অপুর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেতেন। তাঁর কথায়, ‘আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য সময়কে ধারণ করা। যার হাতে প্রদীপ নেই, সে পথ হারায়। বই সেই প্রদীপ, যা হাতে থাকলে মানুষ গন্তব্য চিনে ফেলে।’ এখন পর্যন্ত তিনি লিখেছেন দুটি কাব্যগ্রন্থ, কোনো খ্যাতির জন্য নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই লিখেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস, বই নতুন করে ভাবতে শেখায়। তাই তিনি চান, বইয়ের জন্য হোক সৃজনশীল উপস্থাপনা, মানসম্মত প্রকাশনা। বই নিয়ে হোক পডকাস্ট, ভিডিও, রিভিউ, যা পাঠক তৈরির নতুন দরজা খুলে দিতে পারে।
অন্যদিকে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ লেখক ইয়াসিন আরাফাত ছোটবেলা থেকেই ভাবনায় থাকতেন সাহিত্য, ইতিহাস আর সমাজ নিয়ে। তাঁর মনে হতো, বলার মতো তাঁরও কিছু আছে, যা মুখে নয়, কলমেই বলা সম্ভব। তাই লেখায় হাতেখড়ি। তিনি বলেন, ‘লেখার মাধ্যমে সত্য বলা যায়, প্রতিবাদ গড়ে তোলা যায়। আর নিজেকে জানতে হলে পড়তে হবে। শুধুই পাঠ্যবই নয়, জানতে হবে সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, জীবনী সবই।’ বই তাঁর চোখে আত্মার আয়না। তাঁর বিশ্বাস, বই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে, সমাজ বদলাতে পারে। ইতিহাসও সেই কথাই বলে। দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো কিংবা মেইন ক্যাম্প এই বইগুলো শুধুই পাঠ্য নয়, এগুলো বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ বদলে দিয়েছে। তাই যারা লেখালেখিতে আগ্রহী, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘দ্বিধা না করে শুরু করো। ছোট ছোট ভাবনা একদিন বই হয়ে ওঠে।’
তরুণদের বইয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহিত করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মিনহাজ উদ্দীন। তাঁর মতে, বই হচ্ছে মানুষের চিন্তা, অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার সমষ্টি। বইয়ে মানুষের ৬০-৬৫ বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে। এটা এক অমূল্য বিষয়। স্যার তোফাজ্জল বলেছিলেন, ‘তুমি যদি না পড়ো, তুমি লিখতে পারবে না।’ আমি বজলুর রহমান স্মৃতিপদক পেয়েছিলাম। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
তিনি প্রযুক্তির ভূমিকার কথাও স্বীকার করেন। বলেন, ‘বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশকে অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই মানুষ এখন ই-বুক পড়ে। প্রযুক্তির বিকাশে ছাপা বইয়ের আবেদন কিছুটা কমে যাচ্ছে। তবুও যারা বইপড়ুয়া, তারা বই পড়বেই। তাই ডিজিটাল যুগে মানুষ বই থেকে দূরে সরে যাবে এই পক্ষের লোক আমি নই। ছাপা বইয়ের এক আলাদা আবেদন পাঠকদের কাছে রয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে বই পড়ার কিছু সাইড ইফেক্ট রয়েছে, কিন্তু ছাপা বইয়ের কোনো সাইড ইফেক্ট নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি তরুণদের বলব, বেশি বেশি বই পড়তে। কারণ, বই পড়লেই দেশ ও সমাজকে জানতে পারবে, নিজেকে জানতে পারবে, লিখতেও পারবে।’
এইসব গল্প, ভাবনা আর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়, বই শুধু জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়, এটি আত্ম-অন্বেষণের পথ। তৃষ্ণার্ত মনে বই দেয় শান্তি। একেকটা বই একেকটা জগৎ, যেখানে পাঠক চিন্তা করে, স্বপ্ন দেখে, আর নিজের সঙ্গে কথা বলে। যুগ বদলায়, পৃষ্ঠার ধরন বদলায়, কিন্তু বই থাকে অমলিন।
এফকে/ কাজী সানজিদা কাঁকন