রাজমিস্ত্রীর কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন নোয়াখালীর মোহাম্মদ শাকায়েত উল্যাহ। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটে ৩১৯তম এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে ৫৬৩তম হয়েছেন তিনি।
শাকায়েত নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চর আমানুল্লাহ গ্রামের কৃষক মোস্তফা কামালের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। সেই অভাবকে সঙ্গী করেই শুরু হয় তার পথচলা। ক্লাস সিক্স থেকেই নিজের খরচ নিজেই চালাতে শুরু করেন তিনি।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনার প্রতি শাকায়েতের মনোযোগ কমে যায়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিয়মিত ক্লাস না করে বেশি সময় কাটাতেন টিকটকে। আশেপাশের অনেকেই তখন বলত, ‘এই ছেলেকে দিয়ে কিছু হবে না।’ যদিও তার নিজের কাছে বিষয়টা খারাপ লাগত না। ধীরে ধীরে এই আসক্তি তাকে পড়াশোনা থেকে ঠেলে দেয় আরও দূরে।
একসময় পারিবারিক অভাব এতটাই চরমে পৌঁছায় যে কলেজে না গিয়ে টানা পাঁচ মাস রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে হয় তাকে। সেই কষ্টার্জিত অর্থ দিয়েই আবার ফিরে আসেন পড়াশোনায়। কিন্তু প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে পারেননি। ঠিক তখনই পরিচয় হয় আকাশ স্যারের সঙ্গে। তার পরিচালিত কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন শাকায়েত, সেখান থেকেই জন্ম নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন।
এই কোচিং থেকেই এইচএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। পরে বাড়িতে গিয়ে বাবাকে ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে জানান। কিন্তু অভাবের সংসারে ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে না ভেবে শাকায়েতের বাবা তার পড়াশোনার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেন। সেখানেই আবার সাহস দেন আকাশ স্যার। তিনি বলেন, ‘শুধু পরিবার নয়, নিজের চেষ্টাতেই বদলানো যায় ভাগ্য।’
এরপর ‘ফোকাস’ কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায়। কিন্তু কোথাও চান্স না পেয়ে ভেঙে পড়েন তিনি। বাড়ি ফিরে আবারও শুরু করেন রাজমিস্ত্রীর কাজ। ওই উপার্জিত অর্থেই দ্বিতীয়বার ভর্তি হন ‘স্কুল অব এক্সিলেন্স’ নামক কোচিং-এ। এবার আরও বেশি প্রস্তুতি নিয়ে বসেন ভর্তি পরীক্ষায়। তবুও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০৭৭তম হয়ে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। ভাবেন, ‘আমার দ্বারা হয়তো কিছু হবে না।’
কিন্তু থেমে যাননি। শেষবারের মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিট এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে অংশ নেন। কুবির পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথেই জানতে পারেন রাবিতে ৩১৯তম মেধাক্রমের কথা। আনন্দে কেঁদে ফেলেন শাকায়েত। কিছুদিন পর কুবির ফলাফলও প্রকাশিত হয়, সেখানে তিনি অর্জন করেন ৫৬৩তাম মেধাস্থান।
রাজমিস্ত্রীর হাতুড়ি-পেরেক পেরিয়ে অবশেষে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পৌঁছে যায় শাকায়েত।
শাকায়েত বলেন, ‘আমি সব সময় চেয়েছি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। আল্লাহর রহমতে আজ তা সম্ভব হয়েছে। ক্লাস সিক্স থেকেই কাজ করে পড়েছি, যাতে বাবাকে কষ্ট না দিতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ যদি আমাকে আকাশ স্যারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে না দিতেন, তাহলে আমি কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতাম না। আল্লাহ ওনার মঙ্গল করুন।’
/মাহিদুল ইসলাম রাজিব, আসিফ মাহমুদ