MCJ NEWS

বিশ্ব হাসি দিবসে প্রশ্ন: হাসি কি আসলেই সবার জন্য?

সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ছড়া ‘রামগড়ুড়ের ছানা / হাসতে তাদের মানা’ যেন আজকের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। সেই ছানারা যেমন এক নিষেধাজ্ঞার জালে বন্দি—হাসতে মানা, কাঁদতে মানা, ঠিক তেমনি আজও আমরা বন্দি হাসির অলিখিত বিধিনিষেধে।

নারীদের জন্য এই বিধিনিষেধ আরও কঠিন, আরও সূক্ষ্ম। আর পুরুষদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয় এক ভিন্ন রকমের বোঝা,সবসময় আবেগহীন, গম্ভীর থাকার চাপ। হাসলেও সমস্যা, না হাসলেও প্রশ্নবাণ। রামগড়ুড়ের ছানাদের মতোই যেন আমরা সবাই এক হাসিবর্জিত সংস্কৃতির অংশ।

আজ ৪ মে, বিশ্ব হাসি দিবস। ১৯৯৮ সালে চিকিৎসক মদন কাটারিয়ার হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক বৈশ্বিক হাসির আন্দোলন,লক্ষ্য ছিল ইতিবাচকতা, মানসিক সুস্থতা এবং শান্তি ছড়িয়ে দেওয়া, শুধু হাসির মাধ্যমে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়,এই হাসি কি সবার জন্য সমানভাবে সহজ ও মুক্ত? সমাজের কাঠামো কি সত্যিই আমাদের খোলামনে হাসতে দেয়?

হাসিকে এখনো দেখা হয় ‘নিয়ন্ত্রিত আচরণ’ হিসেবে। আজও সমাজে, এমনকি শিক্ষিত পরিমণ্ডলেও, কোনো নারী যদি খোলামনে হেসে ওঠেন, তখনও কানে বাজে প্রশ্ন—“অত হাসে কেন?”, “লজ্জা-শরম কিছু নেই?”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মিথিলা, তার ঠোঁটে এক ব্যঙ্গ-হাসি এনেই বললেন, “সমাজে নারীকে সংযত রাখার সবচেয়ে নীরব অস্ত্রটাই বোধহয় হাসি। একজন নারী কখন, কীভাবে, কতটা হাসবে,এই দায়িত্বও যেন সমাজ নিয়েই বসে আছে।” নারীর হাসি অনেকের চোখে যেন চটুলতা, ইঙ্গিত বা উগ্রতা হয়ে ওঠে।

গবেষণায়ও উঠে এসেছে, নারীর হাসি এখনো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার,যেখানে তা হয়ে ওঠে ‘মেসেজ’ বা ‘মনোরঞ্জনের মাধ্যম’। হাসি তখন আনন্দ নয়, হয়ে যায় সমাজের চোখে এক ধরনের সংকেত। অথচ হাসি তো নিঃশর্ত, সহজ এক অনুভব হওয়া উচিত,যার পেছনে কোনো অনুমান টানার প্রয়োজন নেই।

পুরুষরাও মুক্ত নন এই হাসিবন্ধন থেকে। “কাউবয় সিনড্রোম” বা stoic masculinity নামক এক ধারণা পশ্চিমা মনস্তত্ত্বে বহুদিন ধরেই আলোচিত,যেখানে একজন পুরুষকে সবসময় কঠিন, আবেগহীন, সংযত থাকতে শেখানো হয়। হাসিকে ভাবা হয় দুর্বলতা।

এই সিনড্রোমের বাইরে যাওয়ার সাহসও রাখেন অনেকে। তেমনই একজন মাহমুদুল হোসাইন আকাশ, তিনি তার প্রাণোচ্ছল হাসি হেসেই বলেন-“হাসি আমার স্বভাবজাত। কে কী ভাবল বা কীভাবে দেখল, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। নিজের মতো করে হেসে নেওয়াটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় শান্তি।”

সাহিত্যে, সিনেমায়, সংস্কৃতিতে আজও এর প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। নারীর হাসি রহস্যময়তা বা প্রলোভনের প্রতীক, আর পুরুষের গাম্ভীর্য বুঝিয়ে দেয় তার শক্তিমত্তা। অথচ বিশ্ব হাসি দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—হাসি কেবল আনন্দ বা বিনোদনের প্রকাশ নয়, এটি একটি মানবিক অধিকার।

এমন একটি সমাজ গঠনের সময় এখনই, যেখানে হাসি হবে অবাধ, নিরপেক্ষ, এবং লিঙ্গ-নির্বিশেষে সবার জন্য সমান।

কেএইচ/সায়েমা হক

শেয়ার করুন -