MCJ NEWS

প্রেম, প্রতিবাদ আর প্রেরণার নাম নজরুল

প্রেম, প্রতিবাদ আর প্রেরণার নাম নজরুল

আমিনা কবির শ্রেষ্ঠা

জ্যৈষ্ঠের দাবদাহে জ্বলছে পথঘাট, নিথর বাতাসে থমকে আছে চারপাশ। এমন এক উত্তপ্ত দিনে বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন এক অনন্য কণ্ঠস্বর—কাজী নজরুল ইসলাম। সেদিন তিনি শুধু কাজী রফিজউদ্দীনের সন্তান, সাধারণ এক শিশুই ছিলেন। অথচ সময় জানত না, এই শিশু একদিন শব্দ দিয়ে নির্মাণ করবে প্রেমের সুর, প্রতিবাদের ব্যারিকেড, আর মানবতার মহীরুহ।

নজরুলের শৈশব ছিল কঠিন বাস্তবতায় ঘেরা। রূপকথার ছায়া ছিল না কোথাও। খালি পেটে রুটির দোকানে কাজ, লেটোর দলে গান গাওয়া আর একরাশ স্বপ্ন চোখে নিয়ে বেড়ে ওঠা। অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে বুঝে গিয়েছিলেন—জীবন সহজ নয়। কিন্তু তবুও, এই শিশুটিই শব্দের জাদুতে গড়ে তুলেছিলেন সাহসী সাহিত্যভুবন।

তার সেই ভুবন থেকেই এসেছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প—যেখানে প্রেম যেমন প্রবল, প্রতিবাদ তেমনি দৃপ্ত। গানের ছন্দে, কবিতার কথায়, গল্পের বাঁকে বাঁকে ফুটে উঠেছে মানবতার জয়গান।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুল হাসান ছোটবেলায় ভাবতেন, নজরুলের মতো কবি হওয়া যায় কি না। জন্মদিন এক হওয়ায় তার মধ্যে এক আত্মিক টান কাজ করত। তিনি বলেন, “নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ৎ’-এর ওই লাইন—‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে’—আমাকে সবচেয়ে শক্তি দেয়। আজও যত আন্দোলন দেখি, নজরুলকেই সবচেয়ে জীবন্ত মনে হয়।”

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নজরুল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতের নানা প্রান্ত, এমনকি মেসোপটেমিয়া—আজকের ইরাক পর্যন্ত। যুদ্ধক্ষেত্রেও তাঁর কবিত্ব থেমে থাকেনি। আরবি-ফারসি শব্দভাণ্ডার আত্মস্থ করে গড়ে তুলেছিলেন এক বৈচিত্র্যময় সাহিত্যভঙ্গি।

তাঁর জীবন শুধুই দ্রোহের নয়, ছিল বেদনাও। কবির জীবনের অসংখ্য বেদনাবিধুর গল্পের মধ্যে একটি—তাঁর চার বছরের ছেলে, বুলবুলকে ঘিরে। এক রাতে শিশুটি মারা যায়, আর কবির কাছে তখন একটাও কানাকড়ি নেই। কাফন, দাফন, গোরস্থান—সব মিলিয়ে দরকার ১৫০ টাকা। সাহায্যের হাত বাড়ানো হলো, ডিএম লাইব্রেরি মাত্র ৩৫ টাকা দিল। বাকিটা জোগাড়ের জন্য কবি গেলেন প্রকাশকের কাছে। প্রকাশক বললেন, এই মুহূর্তে কবিতা চাই, তাহলেই টাকা। চোখে জল, বুকভরা কষ্ট নিয়ে নজরুল লিখলেন—

ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হ’য়ে আমার গানের বুলবুলি,
করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি…

নজরুলের বেদনা থেকে যেমন জন্ম নিয়েছে করুণ কাব্য, তেমনি নজরুল সৃষ্টি করেছেন ভালোবাসা, প্রতিবাদ আর প্রতিবিম্বের এক অজস্র জগৎ। প্রায় চার হাজার গান রচনা ও সুরারোপ করে তিনি বাংলা গানের ভুবনে এনে দিয়েছেন নতুন এক ধারা—নজরুলগীতি। তাঁর গানে মিশেছে ফারসি-আরবি রাগ, লোকসুর, প্রেম, প্রতিবাদ, প্রকৃতি আর দেশপ্রেমের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

তিনি শুধু প্রেমের কবি ছিলেন না, ছিলেন প্রতিবাদের অগ্রপথিক। নারী যখন সমাজে অবদমিত, নজরুল তখন নির্দ্বিধায় লিখেছিলেন—

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

ধর্মের নামে বিভেদ মানেননি তিনি। মুসলিম হয়েও দুর্গাপূজায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, উৎসবে কবিতা লিখেছেন। মৌলবাদীদের ভ্রুকুটি তাঁকে দমাতে পারেনি। তিনি ছিলেন সংস্কৃতির অকুতোভয় সৈনিক। আবার এক বিকেলে বসে ২১টি ইসলামি গজল রচনা ও সুর দিয়ে নজরুল প্রমাণ করেছিলেন—তাঁর সৃষ্টি শুধু পরিমাণে নয়, ভাবনাতেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

তাঁর গানের তালিকাও যেন শেষ হওয়ার নয়—’আমার আপনার চেয়ে’, ‘রুম ঝুম বাদল আজি’, ‘তাওহিদেরই মুর্শিদ আমার’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’… প্রতিটি গান যেন সময়ের সাক্ষী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট, পদ্মভূষণ, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার—সম্মান কম পাননি নজরুল। তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট, বিমানবন্দর, মেট্রো স্টেশন—কত কিছু। তবু নজরুল বড় হয়েছেন এই সব পরিচয়ের চেয়েও।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাস্পিয়ান বলেন, ‘নজরুলের প্রথম পড়া কবিতা ছিল, ‘ভোর হলো দোর খোলো’। তখন কতই না সাধারণ মনে হয়েছিল কবিতাটি। কিন্তু বড় হওয়ার পর, ভেবে অবাক হই—দশম শ্রেণি পাশ একজন কবির কত প্রভাব! তাঁর কবিতা অনার্স, মাস্টার্সে পড়ানো হয়, গবেষকরা তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর কবিতা এক ধরনের স্পৃহা, শক্তি জোগায়।’

আজ জ্যৈষ্ঠের এই দিনে আমরা শুধু নজরুলকে স্মরণ করি না, আমরা তাঁকে অনুভব করি—প্রেমের প্রতিটি উচ্চারণে, প্রতিবাদের প্রতিটি অক্ষরে, সাহসের প্রতিটি স্পন্দনে। কারণ নজরুল শুধুই কবি ছিলেন না—তিনি ছিলেন আগুনের ভাষ্যকার, সমাজের দর্পণ, হৃদয়ের বিদ্রোহ।

/কেএইচ

শেয়ার করুন -