MCJ NEWS

কালা চাঁদের কোরবানি

আমার নাম কালা চাঁদ। মালিক আমাকে আদর করে ডাকত কালী। কুচকুচে কালো রঙ, মাঝারি গড়ন, গলায় একটা ছোট ঘণ্টা—হাঁটলে টুনটুন করে বাজত। আমি থাকতাম গ্রামের এক প্রান্তে, হুজুর সাহেবের গোয়ালে।জীবনটা খারাপ ছিল না। খড়-ভুসির মিশ্রণ, গুড়মিষ্টির খাওয়ারে আমার দিন কাটত রাজকীয় আয়েশে। দুপুরে গোসলের পর মালিক নিজ হাতে খাওয়াতেন। মাঝে মাঝে ঘাড়ে গোলাপজলও ঢালতেন। তখন নিজেকে ভাবতাম হুজুরের বাড়ির নবাব।

তবে সেই সুখের দিন খুব বেশিদিন টিকল না। একদিন দেখি, কিছু লোক আসছে। আমার শরীর দেখে, দাঁত টেনে দেখে, কেউ পেছন দিকেও তাকায়। লজ্জায় কুঁজো হয়ে যাই। কেউ বলে, “পাঁচ লাখ তো হবেই!”

আমি ভাবি—‘পাঁচ লাখ কী? আমার দাম? আমি তো এই বাড়ির এক সদস্য!’

তারপর এল সেই দিন—‘গরুর হাট’। আমাকে সাজিয়ে তোলা হলো চকচকে নতুন গরুর মতো। গলায় ফুলের মালা, কপালে চন্দনের ফোঁটা। হাটে গিয়ে দেখি, আমার মতো হাজার গরু দাঁড়িয়ে আছে। কারো চোখে ভয়, কারো চোখে বোকার সুখ। বুঝে ফেললাম, এই সাজসজ্জা আসলে বিদায়ের সূচনা।

বিকেলের দিকে এক মধ্যবয়স্ক লোক এসে আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখল। সঙ্গে তার ছেলে। ছেলে চিৎকার করে বলল, “বাবা , আমার এই গরুটাই চাই!”

সব শেষ। দাম ঠিক হলো, টাকা দেওয়া-নেওয়া শেষ। হুজুর আমার গলায় জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। কিন্তু অভিমানে আমি ফিরে তাকাইনি। সবকিছুই তখন শুধুই নাটক মনে হলো।

এরপর নতুন বাড়িতে যখন এলাম, তখন চারপাশে উৎসবের আমেজ। নাম বদলে ‘কালা চাঁদ’ থেকে হয়ে গেলাম ‘কালু’। যত্নে কোনো ঘাটতি নেই। খাওয়াদাওয়া, আদর, ভালোবাসা সব কিছু যেন নতুন করে শুরু হলো।

ঈদের আগের রাতে আবার আমাকে সাজানো হলো ফুলের মালায়। ভাবলাম, এই বুঝি ঈদের নামাজে যাচ্ছি!

কিন্তু সকালবেলায় ভিড় জমল আমার চারপাশে। হইচই, সেলফি, কানাকানি। তারপর এক সাদা পাঞ্জাবি হুজুর হাতে নিলেন চকচকে ছুরি—তবে সেটায় তখনও আগের গরুর রক্ত। তখন বুঝলাম, এই যে সবাই বলছে ‘কুরবানি’, এটাই আমি!

ছুরি একবারেই কাজ করল। লোকেরা খুশি। বলে, “এক ছুরিতেই কাজ শেষ! হুজুর একদম এক্সপার্ট!” আমার তাজা রক্তে যেন ঈদের স্বাদ খুঁজে পায় মানুষ।

আমি এখন আর ওই পৃথিবীর গরু নই। আমি এক “কুরবানিকৃত মহান আত্মা”—সাবেক কালা চাঁদ। ছুরির এক কোপে শেষ হলো জীবনের গল্প।

কিন্তু, মরেও শান্তি নেই! ঈদের পরদিন আকাশ থেকে উঁকি মেরে দেখি, কেউ দাঁত দিয়ে আমার হাড় চিবোচ্ছে, কেউ গলা পর্যন্ত মাংস গুঁজে বলছে, “আহ! একেবারে স্বর্গীয় স্বাদ!”

বাচ্চারা আমার নামেই ছড়া বানায়—
“কালা চাঁদ এলো, মাংস দিল,
এখন সে কান্দে, বসে বসে চান্দে।”

আর সেই ছোট ছেলেটা যে হাটে আমাকে দেখে বলেছিল, “এই গরুটাই চাই”—সে ফেসবুকে আমার সাথে তোলা সেলফি দিয়ে লিখেছে: “With #KalaChand, before he goes to Jannah.”

আহা জীবন! মরেও যেন শান্তি পাওয়া গেল না।

/কাজী ফাহমিদা কানন

শেয়ার করুন -