কোরবানির ঈদ মানেই ছিল চেনা এক উৎসব—হাটে যাওয়ার আগেই শুরু হতো উন্মাদনা। গরুর গায়ের রং, শিংয়ের বাঁক, চোখের চাহনি সবকিছু নিয়ে চলত আলোচনার ঝড়। হাট থেকে গরু আনার পথে পাড়ার ছেলেমেয়েরা ছুটে আসত পেছনে পেছনে। বাড়িতে এসে সেই গরুই হয়ে উঠত পরিবারের এক সদস্য। তাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, নাম রাখা সবকিছুতেই ছিল আনন্দের ছোঁয়া।
কিন্তু এখন ঈদের সেই আমেজ অনেকটাই বদলে গেছে। শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামেও এসেছে পরিবর্তনের ছাপ। গরুর সঙ্গে গড়ে ওঠা সেই মায়ার সম্পর্ক কিংবা কাদামাটিতে মাখা গরুকে হাট থেকে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা এখন নেই বললেই চলে। ঈদ এখনো আসে, কিন্তু শৈশবের সেই মাটির গন্ধ মাখা ঈদ কোথাও হারিয়ে গেছে। এখনকার কোরবানি যেন অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর এক ভার্চুয়াল আয়োজন।
শৈশবের সেই দিনগুলো আজো অমলিন হয়ে আছে প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলামের মনে। তিনি বলেন, “তখন এতকিছু বুঝতাম না, শুধু জানতাম ঈদের মানে আনন্দ আর গরু। বাবা-চাচারা হাটে যাওয়ার কথা বললেই মনটা লাফিয়ে উঠত। সঙ্গ পেতে বায়না করতাম, বলতাম সবচেয়ে বড় লাল গরুটা কিনতে হবে!” সেই গরু এলেই শুরু হতো নতুন আরেক উৎসব। কে গরুকে খাওয়াবে, কে নাম রাখবে, কে পাশে বসে থাকবে। এক ধরনের মায়া তৈরি হতো গরুর প্রতি। কিন্তু ঈদের দিন সকালে সেই মায়া ছিঁড়ে যেত কোরবানির দৃশ্যে। শিশুমন ভিজে উঠত করুণায়। তবু সেখানেই শেখা হতো আত্মত্যাগের শিক্ষা, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসার জায়গা থেকেও কিছু ছাড়তে শেখা।
আজকাল এই গল্পগুলো কেবল স্মৃতির পাতায়। এখনকার অনেক শিশুর কাছে গরু কেনা মানে ভিডিও দেখা, কিংবা একটি ছবি তুলে পোস্ট দেওয়ার উপলক্ষ। কুরবানি নিয়ে আগের সেই প্রাণচঞ্চল প্রস্তুতির জায়গায় এসেছে ভার্চুয়াল আয়োজন। বাজারে ঘোরা, পশু বাছাই আর পরিচর্যা করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখনকার প্রজন্ম।
এই পরিবর্তন শুধুই প্রজন্মের নয়, পরিবর্তন এসেছে পারিবারিক রীতিতেও। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা তানিয়া সুলতানা স্মরণ করিয়ে দিলেন অন্য এক চিত্র। “আগে মা-চাচিরা ভোরবেলা থেকেই মসলা বাটতেন। মাংস কাটাকাটি শুরু হওয়ার আগেই পরিকল্পনা করে ফেলতেন কে কতটা মাংস পাবে। দরিদ্র প্রতিবেশীদের আগে ভাগেই বণ্টন করে দেওয়া হতো। ঈদের আনন্দ তখন কেবল পরিবারের গণ্ডিতে আটকে থাকত না, ছড়িয়ে পড়ত পুরো মহল্লায়।” তাঁর কথায় উঠে আসে এক ধরনের আক্ষেপ—“এখন দেখি মানুষ মাংস ফ্রিজে রাখতেই ব্যস্ত। বণ্টনের জায়গায় এসেছে জমিয়ে রাখার প্রবণতা।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মোরাদুল খন্দকারের কন্ঠ বেজে উঠল করুন সুরে। “আগে কুরবানি মানে ছিল ধৈর্য ও আত্মসংযমের অনুশীলন। এখন অনেকের কাছে কুরবানি যেন প্রতিযোগিতা—কে বড় গরু কিনল, কার পশু বেশি দামী, এসব নিয়ে আলোচনা হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।” কুরবানি এখন যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘শো অফ’-এর একটা উপলক্ষ, যেখানে ছবি, ক্যাপশন আর রিলের ভেতর হারিয়ে যায় ত্যাগ, শৃঙ্খলা আর নম্রতা।
এই প্রসঙ্গে কথা হয় এক প্রান্তিক খামারি এমতাজ উদ্দীনের সঙ্গে। তাঁর কণ্ঠে মিশে থাকে বাস্তবতার কঠিন সুর। “এখন মানুষ গরু কিনতে আসে এগ্রো ফার্মে, ওজন দেখে, জাত দেখে। আমরা যারা নিজের হাতে দেশি গরু পালি, তারা এত খরচ করতে পারি না। দামি ভুট্টা বা দানাদার খাবার দেওয়া আমাদের সাধ্যের বাইরে। তবে এখনো কিছু মানুষ আছে, যারা দেশি গরুর মূল্য বোঝে। তারা খোঁজ নেয়, কথা বলে, আসে। সেই জায়গাটুকু এখনো বেঁচে আছে বলেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি।”
পুরনো সেই সময়টা হয়তো আর ফিরে আসবে না। সময়ের গতিতে ঈদের ধরন বদলেছে, বদলেছে মানুষের মন-মানসিকতা, সম্পর্কের ধরন, আনন্দের ভাষা। তবু তাজুল স্যারের মতো কারও স্মৃতিতে আজো ভেসে ওঠে বড় লাল গরুটার জন্য করা আবদার, কিংবা সেই ভোরের মসলার ঘ্রাণ—যা আজও নিঃশব্দে জানান দেয়, ঈদ কেবল উৎসব নয়, এটি এক আত্মিক অনুভব, স্মৃতি আর হৃদয়ের টান।
/রাইসুল ইসলাম