
আজও আকাশ নীল। তবে সে নীল আকাশে আজ বিষাদের এক পরত লেগে আছে। শহরের অলিগলি ছুঁয়ে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আজ কোরবানির ঈদ। অথচ, কারো কারো মনটা ভার। আনন্দের দিনে এমন বিষণ্ণতা এটা কি শুধু দূরত্বের কারণে, নাকি প্রিয় মানুষগুলোর স্পর্শ না পাওয়ার অভাব?
প্রবাসের মাটিতে ঈদ আসে নিঃশব্দে। না থাকে পশুর হাটের সেই চিরচেনা হাঁকডাক, না থাকে মায়ের হাতের গরম সেমাইয়ের সুবাস। মসজিদ থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর সবই যেন স্মৃতির কুয়াশায় ঢেকে যায়। সেই কুয়াশার চাদর সরিয়ে জাপানে কর্মরত সায়হান চৌধুরী বলেন, “সবাই মিলে গরু কেনা, বন্ধুদের সঙ্গে চাঁদরাতে আড্ডা, দল বেঁধে পশু দেখতে যাওয়া, ঈদগাহে নামাজ শেষে কোরবানি এসবই সবচেয়ে বেশি মিস করি। এখানে ঈদ মানেই ফোনে মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলা, আর রুমে হালকা একটু রান্না করা। ব্যস্ততার ভেতর ঈদ যেন হারিয়ে যায়।”
ঈদ যখন শুধু স্মৃতি হয়ে ওঠে, তখন প্রবাসে থাকা মানে নিছক দূরত্বে থাকা নয়, তা অনুভবেও এক তীক্ষ্ণ ছুরির মতো বয়ে যায় হৃদয়ে। একেকজনের ঈদ, একেকরকম একাকীত্বের গল্প হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডে পিএইচডি করছেন শাহরিয়ার খান নোবেল। তিনি বলেন, “দেশে ঈদ আর বিদেশে ঈদের আনন্দ অবশ্যই আলাদা। ঈদ মানে পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব আর একটা ছুটির দিন এমনটাই জেনেই আমরা বড় হই। মুসলিম-প্রধান দেশ না হলে এখানেই প্রথম পার্থক্য। এখানে ঈদের কনসেপ্টই তো নেই। দেশের মতো এখানে ঈদের দিন মানেই ছুটি এমনটা হয় না। ক্লাস, পরীক্ষা সব চালু থাকার মতো স্বাভাবিক আরেকটা দিনই। সবাই চেষ্টা করে, অন্তত ঈদের নামাজের সময় যেন কিছু না থাকে। তবে মাঝে মাঝে, কারও কারও সেটাও হয় না।”
তাই সবার প্রত্যাশা থাকে, ঈদ যেন শনিবার বা রবিবারে হয়। সেরকমটা হলে, সবার ছুটির দিন হিসেবে ঈদের নামাজ সেরে, একে অপরের বাসায় সেমাই-মিষ্টি খেতে যাওয়া বা কয়েকজন মিলে বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয়। তবে সবার মনেই পরিবার, প্রিয়জন, দেশ থেকে দূরে থাকার একটা চাপা কষ্ট রয়েই যায়।
প্রবাসে ঈদ মানেই নিরন্তর বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া। ঈদের দিনে কোরবানির পশু জবাই করা, সেই আনন্দ ভাগ করে নেওয়া এসব যেন কিছুই রূপ নেয় অসম্ভব এক চেষ্টায়। দেশের ঈদের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠিকই, কিন্তু ছুঁয়ে দেখা যায় না। দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষায় থাকা জুয়েল বলেন, এখানে এটি আমার ষষ্ঠ ঈদ। সত্যিকার অর্থে, পূর্বের ঈদগুলোর মতোই এটিও আমার জন্য বেদনাদায়ক। বাংলাদেশে যখন পরিবারের সবাই ঈদকে ঘিরে আনন্দ করছে, তখন আমার সকালটা শুরু হয় একাকীত্ব দিয়ে। মায়ের হাতের রান্নার ঘ্রাণ, নতুন জামা, আতরের সুবাস, চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে আনন্দ করা এই সবকিছুই তখন ভীষণভাবে মিস করি। এখানে ঈদের দিন যেন আর দশটা দিনের মতোই। নামাজ শেষে ক্লাসের জন্য বেরিয়ে যেতে হয়। এসাইনমেন্ট, ক্লাসের তাড়া সব মিলিয়ে যেন আনন্দের কোনো অবকাশই নেই।”
দিন শেষে ভিডিও কলে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা হয়। সবার মুখে হাসি দেখলেও ভিতরে ভিতরে একটা স্তব্ধতা জমে ওঠে। তবু শত চাপা কষ্টের মাঝেও নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে আবার কাজে ফিরে যান জুয়েল। তাঁর কণ্ঠে ধরা পড়ে এক সহজ সত্য—“এটাই আসলে আমার ঈদ।”
এইসব গল্প শুধু নিঃসঙ্গতার নয়, আত্মত্যাগেরও। প্রবাসীরা যেন কোরবানির প্রকৃত অর্থকেই লালন করেন হৃদয়ে। তারা জানেন, ঈদের ত্যাগ শুধু পশু জবাই নয়—ভালোবাসার জন্য, পরিবারের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য নিজের দিনরাত নিঃশব্দে উৎসর্গ করে যাওয়া। কেউ দেশে কোরবানির জন্য টাকা পাঠান, কেউ আবার কাজের ফাঁকে পরিবারের খোঁজ নেন ফোনে। এই দৃশ্য যেন ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব আর আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। ফিনল্যান্ডে অবস্থানরত মাসুম বলেন, “এখানে ঈদ আসলে দেশের মতো না। পরিবার ছাড়া ঈদ চাইলে ঠিকভাবে উদযাপন করা যায় না। এখানে বন্ধুরা আছে, সুযোগ হলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করি, একটু ঘুরতে বের হই। তবে এখানে ঈদ বলতে আলাদা কোনো দিন থাকে না। যাদের সকাল-বিকালের কাজ থাকে, তারা আসলে ঈদে তেমন কিছুই করতে পারে না। ভাগ্যক্রমে কেউ ছুটি পেলে, সবাই মিলে একসাথে নামাজ পড়তে যাই, বাসায় রান্না করি।”
ঈদ-উল-আজহা কেবল কোরবানির উৎসব নয়, এটি ভালোবাসা, আত্মত্যাগ আর একতার এক মহোৎসব। ভিনদেশের মাটিতে থেকেও প্রবাসীরা এই চেতনায় অটুট থাকেন। মাটির দূরত্ব যতই থাকুক, হৃদয়ের সংযোগে ঈদের আলো ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি হৃদয়ে। ঈদ আমাদের শেখায় ভালোবাসা আর ত্যাগের ভাষা কোনো সীমানায় বাঁধা পড়ে না। যেমন চাঁদের আলো পৃথিবীর সব দেশে সমান ঝরে, তেমনি ঈদের উষ্ণতাও ছড়িয়ে পড়ে সব প্রবাসী হৃদয়ে—নিঃশব্দে, কিন্তু গভীর অনুভবে। আর প্রতিটি অনুভবের পেছনে থাকে স্মৃতি, টান আর অপেক্ষা।
/ইব্রাহিম ভূইয়া