সাজিদুর রহমান, মনিরা শিলা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি মানেই কোলাহলহীন ক্যাম্পাস, ফাঁকা ক্লাসরুম, নিস্তব্ধ করিডোর। শিক্ষার্থীরা সবাই ফিরে গেছে বাড়ি, যে যার মতো করে ঈদের আনন্দে। কিন্তু যাঁরা প্রতিদিন ক্লাস নেন, সেমিনারে যান, গবেষণার কাগজে চোখ রাখেন—সেই শিক্ষকরা ছুটিতে কী করেন? তাঁদের জীবন কি থেমে থাকে? নাকি অন্যরকম কোনো ব্যস্ততা পেয়ে বসে?
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের ছুটির গল্প বলছে ঠিক এইসব কথাই। কখনো ব্যক্তিগত টানাপড়েন, কখনো পেশাগত চাপ, কখনো আবার নিঃসঙ্গ অবসর—সব মিলিয়ে ছুটির সময়টা হয়ে ওঠে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
সুনামগঞ্জ না রাজশাহী? ছুটি মানেই সিদ্ধান্তের দ্বন্দ্ব হাসিনা বেগমের
ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা। কিন্তু নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক হাসিনা বেগমের জন্য সেটা সহজ কোনো সিদ্ধান্ত নয়। বাবার বাড়ি সুনামগঞ্জ, শ্বশুরবাড়ি রাজশাহী এই দুই টানের মাঝে তাঁকে ভাবতে হয়, এবারের ছুটিতে কোথায় যাবেন। “ছুটি শুরু হলেই আব্বা প্রতিদিন ফোন করে বলেন, কবে বাড়ি যাচ্ছি?” হাসতে হাসতেই বললেন তিনি।
ছেলেমেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে প্রকৃতির মাঝে কাটানো সময় তাঁর প্রিয়। কিন্তু ছুটি মানেই কি নিখাদ আনন্দ? ক্লাস শুরুর আগেই তাঁকে তৈরি রাখতে হয় ফিল্ডওয়ার্ক, থিসিস সাবমিশন, গবেষণাপত্র জমার জন্য।
“শিক্ষার্থীদের কাজ থেমে থাকে না, তাই ছুটির মাঝেও তাদের নির্দেশনা দিতে হয়। সবকিছু সময়মতো শেষ হবে তো—এই দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে যায় না। শুধু পরিবারের সময় নয়, ছুটি মানেই তাঁর কাছে এক ভারসাম্যের চ্যালেঞ্জ।
আড্ডা, বই আর সিনেমার ছুটিতে মামুন চৌধুরী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মামুন চৌধুরী ছুটিকে বলেন ‘প্রশান্তি ও একঘেয়েমির মিশ্রণ’। “প্রথম ক’দিন খুব ভালো লাগে, কিন্তু ছুটি দীর্ঘ হলে আবার কাজে ফেরার তাড়া লাগে”—বললেন তিনি।
এবারের ঈদটা পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছেন আনন্দে। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, আড্ডার ফাঁকে অনেক সিনেমা আর বই—সব মিলিয়ে তাঁর ছুটি কেটেছে ঘরোয়া উৎসবে।
“ছুটির বাকি অংশে বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাবার প্ল্যান আছে, দেখা যাক কী হয়!”—উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন মামুন। তাঁর ভাষায়, ছুটি তখনই পরিপূর্ণ, যখন তা ভারসাম্যপূর্ণ—কাজ ও আনন্দ, দুটোরই মিশেল থাকে।
ছুটিতে ফাঁকির অপরাধবোধে ড. শিলা
ছুটি মানেই বিশ্রাম—এই ধারণা থেকে অনেক দূরে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুন শিলা। তাঁর ভাষায়, “একদিনও টেনশনমুক্ত ছিলাম না।”
দু’জন থিসিস শিক্ষার্থীর তদারকি, নিজের গবেষণাপত্র সম্পাদনা, খাতা দেখা—সব মিলিয়ে প্রতিদিনই কাজের পাহাড়। এর মাঝেই খানিকটা সময় চুরি করে ফাঁকিবাজি করেন, বলেন—“মোবাইল অফ, সোশ্যাল মিডিয়া লুকানো, কিন্তু বই পড়ার নামে ফাঁকি… তারপরই শুরু হয় অপরাধবোধ।”
এই চাপ আর ফাঁকির মাঝেই তাঁর ছুটি কেটেছে, খানিকটা ক্লান্তিকর, খানিকটা আত্মগ্লানিতে ভরা। তবে এটাও বুঝিয়ে দেয়, শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, এক অন্তর্লীন দায়বদ্ধতা।
ফিল্ডওয়ার্ক আর মায়ের পাশে সোহরাব উদ্দিন
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মোহাম্মদ সোহরাব উদ্দিনের ছুটি হয় না নিছক বিশ্রাম। বরং সেটা পরিবার, গবেষণা আর প্রশাসনিক দায়িত্বে গাঁথা এক কর্মযজ্ঞ।
“ঈদের ছুটিতে আমি বাড়িতে মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করি। এবারও তাই করেছি,”—বললেন তিনি। তবে ছুটির মধ্যেও তাঁকে যেতে হয়েছে পাহাড়পুর আর মহাস্থানগড়ে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজ এবং শিক্ষার্থীদের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম তদারকি করেছেন নিজে। এর ফাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল নিয়েও কাজ করতে হয়েছে তাঁকে।
“সময় কীভাবে কেটে যায়, টেরই পাই না” বলতে গিয়ে যেন নিজের ছুটির পরিধিটাই হারিয়ে ফেলেন তিনি।
পরিবার, দায়িত্ব আর নিজের ভিতরের শিক্ষক সত্তার মাঝেই কাটে তাঁদের দিনগুলো। কোনো শিক্ষক হয়তো গ্রামের বাড়ির সকালে হাঁটেন, কেউ হয়তো খাতা হাতে বসে থাকেন সারা দুপুর। কেউ বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে খেয়াল করেন, থিসিসের একটা লাইন ঠিক হয়নি।
ছুটি তাঁদের কাছে কখনো প্রশান্তি, কখনো চাপ, আবার কখনো আত্মপ্রসাদের একটা ছোট্ট মুহূর্ত। ছাত্রদের জীবনের প্রগতিতে, গবেষণার লাইন ঠিকঠাক বসাতে পারায়, বা মায়ের হাতে রান্না করা ভাতে—উনারাও খুঁজে নেন ছুটির আসল মানে।
/এএম