MCJ NEWS

জুলাই বিপ্লব: ছাত্রজনতার রক্তে ফ্যাসিবাদের পতন

২০২৪ সালের রক্তঝরা জুলাই শুধু একটি ক্যালেন্ডারের মাস নয়, এটি বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে খোদাই হয়ে যাওয়া এক নবজাগরণের নাম। বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে তা রূপ নেয় ছাত্রজনতার রক্তস্নাত গণআন্দোলনে। যেখানে রাজপথে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের দেয়াল আর শিক্ষার্থীদের বুকের রক্তে লেখা হয় স্বৈরাচার বিরোধী স্লোগান। এই জুলাইয়ে জন্ম নেয় এক নতুন বাংলাদেশ যেখানে ছাত্রদের চোখেমুখে ছিল প্রতিবাদের অগ্নিশিখা আর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় অবস্থান।

তবে জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনের শুরুটা ছিলো খুব সাদামাটা। জুলাইয়ের ১ তারিখ ৫৬ ভাগ কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভের পর দাবি মানার জন্য জুলাইয়ের ৪ তারিখ পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ৪ জুলাই, ২০২৪ হাইকোর্টের রায় না দিয়ে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সার্কুলার অবৈধ ঘোষণার শুনানি পেছানোর খবরে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। সেদিন বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান নেয়।
পরদিন, ৫ জুলাই, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে কোটবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় সড়ক অবরোধ, মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি। জনগণের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে আন্দোলন ধীরে ধীরে আরো সুসংগঠিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা আসে—৬ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি এবং ৭ জুলাই থেকে ‘ক্লাস পরীক্ষা বর্জন’।

আন্দোলনের প্রথমদিকে সাধারণ মানুষ বিরক্তের সীমা না থাকলেও কিভাবে সেটা সাধারণ মানুষের কাছে যৌক্তিক দাবি হয়ে গণজাগরণ তৈরি করল সেটাই জানাবেন এই আন্দোলনের সাথে শুরু থেকে যুক্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক।

জুলাইয়ের প্রথম দিকের স্মৃতিচারণ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বায়েজিদ হাসান বলেন, “কোটা প্রথা বাতিলের জন্য জুলাইয়ের ৪ তারিখ সর্বপ্রথম আমরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে কোটবাড়ি বিশ্বরোড মহাসড়কে আসি। ওইদিন প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা কুমিল্লা কোটবাড়ি বিশ্বরোডের রাস্তা শিক্ষার্থীরা অবরোধ করে রাখে। তারপর থেকে বিভিন্ন ফেসবুক, মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে স্কুল, কলেজসহ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে কর্মসূচি চালানো হয়।” “জুলাইয়ের প্রথম দিকের আন্দোলন যদিও জন মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছিলো তবে যখন সারাদেশে নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের উপর স্বৈরাচার সরকার ন্যাক্কারজনক হামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন ও গুম, মামলা ইত্যাদি চালায় তখন সারাদেশের মানুষের মধ্যে একপ্রকার ক্রোধের সৃষ্টি হয়। এই ক্রোধ মূলত ছিলো দীর্ঘ ১৬ বছর স্বৈরাচার সরকারের ফ্যাসিবাদি শাসনব্যবস্থার উপর। সেখান থেকেই পরবর্তীতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে সবাইকে একত্রিত হলে তৈরি হয় গণ-জোয়ার।

‘দৈনিক আমাদের সময়’ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি অনন মজুমদার জুলাই বিপ্লবে মানুষের এগিয়ে আসার কথা স্মরণ করে বলেন, “ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার খাতিরে এই আন্দোলন চলাকালীন মিছিলে এবং মিছিলের বাইরেও বিভিন্ন মানুষের কথা শুনার সুযোগ হয়েছিল। ৪ই জুলাই যখন বিশাল মিছিল নিয়ে কোটবাড়ি বিশ্বরোডে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধের উদ্দেশ্যে কুবির শিক্ষার্থীরা যাচ্ছিলেন, সাধারণ জনগণদের অনেকেই বারবার জানতে চাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এতবড় মিছিল কেন হচ্ছে আর কোথায় যাচ্ছে৷ তখন ঘটনা জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। কিন্তু বিষয়টি যখন খুব বেশি প্রচারিত হতে থাকে তখন অবশ্য মানুষের চিন্তাভাবনা আরও ইতিবাচক হতে থাকে।”

আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় থাকা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফরহাদ কাউসার বলেন, “প্রথম দিকে আমরা যখন রাস্তা অবরোধ করে রাখতাম কিছু কিছু সাধারণ যাত্রী আমাদের উপর রাগ হতেন, ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। তখন আমরা প্রত্যেকটা বাসে উঠে যাত্রীদের বলতাম এই আন্দোলন আপনাদের সন্তানদের জন্যই, যারা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সপ্ন দেখে। আপনার আজকের এই সেক্রিফাইস আগামী দিনে আপনার সন্তানের জন্য একটা ইনভেস্টমেন্ট। কোটা প্রথার বিপক্ষে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আগে থেকেই ছিলো। ধীরে ধীরে যখন এটা বড় আকার ধারণ করলো তখন মানুষ এটা নিজেদের আন্দোলন ভাবতে শুরু করে। তারপর থেকে এই মানুষগুলাই আমাদের সাহায্য করা শুরু করে। পরবর্তীতে দেখা যায়, এদের মধ্যে থেকে কেউ পানি, কেউ বিস্কুট এনে দিতো, নানাভাবে সাহায্য করতো। এভাবেই এই আন্দোলনটা শুরু থেকে ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করে।”

কুবির অন্য শিক্ষার্থী জেসমিন জ্যোশি স্মৃতিচারণ করে বলেন, জুলাইয়ের ১-৭ তারিখে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর দিকেই প্রথম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে, যা শুরুতে সাধারণ মানুষকে বিরক্ত করলেও আন্দোলনের উদ্দেশ্য বোঝার পর তারা শিক্ষার্থীদের সমর্থন দেয়। ১১ জুলাই কুবিতে পুলিশ আক্রমণ করলে সেদিনই আবার শিক্ষার্থীরা সড়ক বন্ধ রাখে। তারপর ১৭-১৮ জুলাই কোটবাড়ি বিশ্বরোডে পুলিশের গুলি ও টিয়ারগ্যাসের মুখে স্থানীয় মানুষ আশ্রয়, খাবার ও ঔষধ দিয়ে সহায়তা করে। ফ্যাসিস্টদের অন্যায়, হত্যা ও গুমের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের কাছে খুব দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা পায়। যারা প্রথম দিকে বিরক্ত হচ্ছিল তারাই নেমে আসে রাজপথে। শেষে ৫ আগস্ট এক মাসের আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও জনগণের একাত্মতায় ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের শুরুর দিকের দিনগুলো ছিলো এমনই। শুরুর দিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিকের স্মৃতিচারণে কুমিল্লার অবদান কেমন ছিলো আন্দোলনে নানা বিষয় উন্মোচিত হয়। এভাবেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানের মধ্য দিয়ে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি আন্দোলন দেশজুড়ে গণঅভ্যুত্থান লাভ করে। সেখানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কুমিল্লার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সমানতালে এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। এভাবেই শুরু থেকে যুক্ত হয়ে একটি আন্দোলনকে করে তুলেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি সফলতম গণঅভ্যুত্থানে।

এফকে/অন্তু অনন্যা, সাঈদ রিফাত

শেয়ার করুন -