MCJ NEWS

প্রকৃত শিক্ষক সে যার প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র,
নানাভাবে নানা জিনিস শিখছি দিবারাত্র।

সুনির্মল বসুর এ-কবিতা যেন শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকের পরিব্যাপ্তিকে উদ্দেশ্য করেই। শিক্ষক শুধু জ্ঞানের দিশারি নন। তিনি শিক্ষার্থীর নৈতিক গুণাবলী, দায়িত্ববোধ ও জীবনের দিকনির্দেশনার পথিকৃৎ। শিক্ষক হলেন সেই আলোকবর্তিকা, যিনি অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দেন। শিক্ষক দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিক উদযাপন নয়; এটি শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। যাদের প্রেরণায় একটি জাতি এগিয়ে যায় স্বপ্নপূরণের পথে।

৫ অক্টোবর—বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকদের অবদানকে সম্মান জানানোর লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়, বর্তমানে যা বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। শিক্ষক এমন এক শব্দ যা নানাজন নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। শিক্ষক দিবস মূলত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মেলবন্ধন, সম্মান ও দায়িত্ববোধের এক দারুণ প্রতিফলন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিবসটি ঘিরে নানা আবেগ, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হাসান রাহাত। শিক্ষকতার মূল দর্শন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার কাছে শিক্ষকতা হলো লাইফস্টাইল। একজন শিক্ষক সার্বক্ষণিকই শিক্ষকতা করেন। নিজে জ্ঞান সাধনার মধ্যে থেকে শিক্ষার্থীদের আলোকিত করাই হচ্ছে শিক্ষকতা। প্রতিটা প্রজন্মের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, তার সাথে শিক্ষকদের খাপ খাওয়াতে হয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ডিজিটালি সক্রিয়। তারা হাতেকলমে শিখতে ভালোবাসে, পাশাপাশি আমাদের চেষ্টা থাকে তাদেরকে ক্রিটিকাল চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করা। তবে বইপত্রের প্রতি তাদেরকে আগ্রহী করে তোলা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।” শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেন,“আমি সবসময় চাই আমার শিক্ষার্থীরা যেন নির্ভয়ে আমার কাছে আসে এবং প্রশ্ন করে। যদি কোনো শিক্ষার্থী একদিন বলে, ‘স্যার, আপনি আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছেন’ তাহলে সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।”

একই বিভাগের শিক্ষক জাকিয়া জাহান মুক্তার মতে, “সমাজের ধারণা, যিনি ভালো পড়াতে পারেন তিনিই শিক্ষক। কিন্তু আমার কাছে শিক্ষক মানে শুধু পড়াতে পারা নয় বরং শিক্ষক এমন একজন ‘লাইফ মডেল’ যাকে শিক্ষার্থীরা অনুসরন করে। তার কথা বলা, জীবনাদর্শ সবকিছুই শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করে। একজন প্রকৃত শিক্ষক সে যার প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে।” প্রিয় শিক্ষক হিসেবে বাবাকে স্মরণ করে তিনি বলেন, “আমার বাবা নিজেও একজন শিক্ষক ছিলেন। আমি তাকে শিক্ষক হিসেবে বেশি শ্রদ্ধা করি এবং তা তার নৈতিক গুণাবলীর জন্য। তিনি শিক্ষকতাকে দেখতেন একটি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে। সেই দায়িত্ববোধই আমার কাছে অনুপ্রেরণা।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রিদওয়ানুল ইসলাম নিজের শিক্ষাজীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনে মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি ধাপেই ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষক পেয়েছি। ছোটবেলায় মাদ্রাসায় শিক্ষকরা শুধু শিক্ষক ছিলেন না, অনেকটা মা-বাবার মতো ছিলেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে চিন্তাভাবনার ভিত গড়ে দিয়েছেন এখানকার শিক্ষকরা।” নিজ অভিজ্ঞতা থেকে আরও বলেন, “একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। মানিব্যাগ হারিয়ে পুরো মাসের খরচ শেষ। সেদিন বিভাগের এক শিক্ষক আমায় দুইহাজার টাকা দিয়েছিলেন কোনো শর্ত ছাড়াই। সে মুহূর্তেই শিক্ষকের ভিন্ন রূপটা চিনেছি। শিক্ষকরাও মানুষ, তাদের ভুল হয়, পক্ষপাত থাকে। তবুও তারা আমাদের জীবনে প্রভাব রাখেন সবচেয়ে গভীরভাবে।”

বাংলা বিভাগের বর্তমান শিক্ষার্থী ফারহা খানম, দিবসটি ঘিরে ভিন্ন চিন্তা ও প্রত্যাশা নিয়ে তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকে শুনেছি শিক্ষকতা মহান পেশা। এর প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- পবিত্র এ পেশার মধ্যে রয়েছে আলো ও অন্ধকারের সহাবস্থান। আমরা প্রায়শই শিক্ষক সম্পর্কিত বেশকিছু ঘটনার সাক্ষী হই। তা কখনও আমাদের জন্য অনেক বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক হয়ে উঠে, কখনও বা চরম বিপর্যয় ও অবনতির কথা স্মরণ করায়। পেশাগতভাবে দায়িত্ব নিলেও অনেকে প্রকৃত অর্থে কখনও ‘শিক্ষক’ হয়ে উঠতে পারেন না। তারা এটাকে ব্যবহার করেন নিজেদের স্বার্থ হাসিলে। ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হয় শত শত স্বপ্ন-সম্ভাবনা। শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকদের কাছে আমার বিনীত প্রত্যাশা— শিক্ষকতা যেন তাঁদের কাছে কেবল একটি পেশা, খ্যাতি কিংবা স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম হয়ে না উঠে। বরং ‘শিক্ষক’ শব্দের পবিত্রতা রক্ষায় তারা যেনো নিজ জায়গা থেকে সচেষ্ট হন।”

শিক্ষক দিবস আমাদের জানান দেয় শিক্ষকের শিক্ষা, নৈতিকতা ও অনুপ্রেরণা ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী পূর্ণতা পায় না। শিক্ষকের পথপ্রদর্শন প্রতিটা শিক্ষার্থীর জীবনকে দেয় এক নতুন আলোকিত পথের দিশা। যে পথ জীবনের সুন্দর গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।

আই/উম্মে হাবিবা মৌ

শেয়ার করুন -