ঝলমলে রোদে এখন আর গরমের তীব্রতা নেই বরং হেমন্তের ছোঁয়ায় বাতাসে মিশে আছে এক হালকা শীতলতা। ভোরের আলোয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর পেরিয়ে যখন কেউ বিবিএ ফ্যাকাল্টির সামনে আসে, হঠাৎই নাকে লাগে মিষ্টি ঘ্রান। গাছের পাতার ফাঁক গলে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে সেই সুগন্ধ। কাছে গিয়ে দেখা যায়—মাটির ওপর ছড়িয়ে আছে ছোটো ছোটো সাদা-গেরুয়া রঙের ফুল, যেন ভোরবেলায় আকাশের নক্ষত্ররা নেমে এসেছে ঘাসের বুকে। তারা আমাদের চিরচেনা শিউলি। কোনো ভার্চুয়াল জগতের সাজানো দৃশ্য নয়, বাস্তবতার পটে স্রষ্টার আঁকা ছবি।
বিবিএ ভবনের পাশের শিউলিতলা শিক্ষার্থীদের কাছে এক শান্তির স্থান। সাতসকালে ক্লাসে আসা শিক্ষার্থীদের চোখে পড়ে মাটিতে বিছানো সেই ফুলেল গালিচা। কেউ কুড়িয়ে নেয় হাতে, কেউ মুগ্ধ হয়ে ছবি তোলে, কেউ বা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই দৃশ্য যেন প্রতিদিনের ব্যস্ততার মাঝে প্রকৃতির কোমল স্পর্শ হয়ে আসে।
বিথী আক্তার কাজল বলছিলেন, “শিউলি দেখতেই একটা স্নিগ্ধতা অনুভব হয়। মনে হয় শিউলি জীবনের কতগুলো সুন্দর সময়, অনুভূতিকে জড়িয়ে আছে। শৈশবে শিউলি নাম শুনলেও সেটাকে অন্য নামে চিনতাম। কিন্তু যখনই শিউলির গাছের ধার দিয়ে যেতাম, এক সুন্দর গন্ধ নাকে এসে লাগতো। দিনের বেলায় রাস্তায় সাদা মুক্তার মতো ছড়িয়ে পড়ে থাকতো। সেগুলো কুড়িয়ে রেখে দিতাম নিজের কাছে। এখনও যখন রাস্তায় শিউলি পড়ে থাকতে দেখি, মনে হয় কুড়িয়ে তুলে নিই সবগুলো”।
কাজলের কথার মতোই, এই গাছ ঘিরে যেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বোনা হয় এক নস্টালজিক বন্ধন—যেখানে শিউলি কেবল ফুল নয়, স্মৃতির মৃদু ঘ্রানে ভেসে থাকা এক টুকরো সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কোণে প্রতিদিন নতুন মুখ আসে, কিন্তু শিউলিগাছগুলো যেন সবাইকে একই অনুভূতির সুতোয় বেঁধে রাখে।
শিউলি শুধু ফুল নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কাহিনি, পুরাণ, আর মানুষের অন্তহীন আবেগ। হিন্দু পুরাণে এর জন্মকথা নানা রূপে পাওয়া যায়। কোথাও বলা হয়, দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গে রোপণ করেছিলেন এই বৃক্ষ, সেখান থেকে কৃষ্ণ চুরি করে এনেছিলেন পৃথিবীতে। আবার আরেক পুরাণে আছে এক রাজকন্যার গল্প, যিনি সূর্যদেবকে ভালোবেসেও পাননি তাঁর প্রতিদান। ভগ্নহৃদয়ে আত্মহননের পর তাঁর ছাই থেকেই জন্ম নেয় পারিজাত বৃক্ষ। তাই শিউলি রাতে ফোটে, ভোরের সূর্য উঠলেই ঝরে যায়—যেন প্রেমের অপূর্ণতা আর জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের প্রতীক।
তবে পুরাণের গণ্ডি পেরিয়ে শিউলি এখন আমাদের সবার। সাহিত্যেও এর প্রভাব গভীর—রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “শিউলি ফোটা ফুরোলো যেই শীতের বনে, এলে যে সেই শূন্য ক্ষণে।” শিউলির এই ঝরে পড়া যেন সময়ের চক্রে ফিরে আসা এক অনিবার্য সৌন্দর্যের বার্তা।
আরেক শিক্ষার্থী নুসরাত তাহসিন জানালেন, ছোটবেলায় বছরের এই সময়ে সকালে মক্তবে পড়তে যাওয়ার আগে ফুল কুড়িয়ে ঘ্রান নিতাম পথ যেতে যেতে। আমাদের ঘরের সামনেই একটা কোনায় শিউলি ফুল গাছ ছিলো। রাতে দরজা খুললেই পড়ার টেবিল থেকে ফুলের ঘ্রান পেতাম। তখন তো শিউলি ফুলের এতো সাহিত্যিক রূপ বা জনপ্রিয়তা জানতাম না, তাই সবসময় বলতাম—কমলা করে বোটা ওয়ালা সাদা ফুলটা। তখন আম্মু বলেছিল এই ফুলের নাম শিউলি। তবে এখন এই ফুল এতটা জনপ্রিয় হয়ে গেছে যে কখনও কখনও মনে হয়, এর সরল সৌন্দর্যটাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও শিউলি দেখলেই মনে পড়ে যায় আমার ছোটোবেলার সেই নিঃস্বার্থ আনন্দ”।
তার কথাগুলো মনে করায়—ফুলের সৌন্দর্য শুধু নামে নয়, হৃদয়ে টিকে থাকে বছরের পর বছর, ঋতু বদলের পরেও। হয়তো এ কারণেই মানুষ নিজের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে শিউলির সঙ্গে সংযোগ খুঁজে পায়।
বিবিএ ফ্যাকাল্টির সামনে থাকা শিউলিতলা নিছক কয়েকটি গাছ নয়; বরং এ যেন প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুদণ্ড শান্তির স্থান। ক্লাসের তাড়া, পরীক্ষার চাপ বা আন্দোলনের ভিড়েও এই গাছ মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃতি সবসময়ই আমাদের সঙ্গী। রাতের অন্ধকারে ফুঁটে ওঠা আর ভোরবেলায় ঝরে পড়া এই ফুল আমাদের শেখায়, সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী হলেও তার প্রভাব রয়েছে। জীবন যতই ছোট হোক না কেন, তার দ্যুতি যেন কখনো সীমায় না আটকায়।
আই/কিফায়াত উল হক

