MCJ NEWS

বইভব আছে নেই পাঠক : ক্রমেই বাড়ছে পাঠবিমুখতা

একটা সময় ছিল, দুপুরের রোদে ক্যাম্পাসের গাছতলায় বসে কেউ হয়তো ‘সাতকাহন’ পড়ছে। পাশে বসা বন্ধুর অনুরোধ “বইটা ধার দিস তো, পড়বো”। অথচ বর্তমানে বাস্তবতায় ভিন্ন চিত্র। আজ প্রযুক্তির বিষ ছোবলে শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল ফোন, চোখে ইউটিউব রিলের চাকচিক্য আর মননে সৃজনশীলতার বদলে ফলোয়ার বাড়ানোর হিসেব। অথচ একই ক্যাম্পাসে গাছের ডালে ঝুলছে ছোট ছোট কাঠের বাক্স, যেখানে আছে বই ও সাহিত্যচর্চার সুযোগ। তবে পাঠকের অনুপস্থিতিতে এসব বাক্স আজ যেন নীরব সাক্ষী একটি হারিয়ে যেতে বসা অভ্যাসের।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সাহিত্যচর্চার বেশ কিছু প্লাটফর্ম। বিশেষ করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ‘বইভব’ একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, যার উদ্দেশ্য ছিল বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করা। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল মুক্ত জ্ঞানচর্চার এক উন্মুক্ত পরিসর। অন্যদিকে লোকপ্রশাসন বিভাগের উদ্যোগে ক্যাম্পাসজুড়ে গাছে গাছে ঝুলছে কাঠের তৈরি ছোট ছোট বইয়ের বাক্স। শিক্ষার্থীরা চাইলে এখানে বই রেখে যেতে পারেন, আবার চাইলে বই নিয়ে পড়ে ফিরিয়েও দিতে পারেন। লাইব্রেরির গাম্ভীর্যপূর্ণ কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে এই উদ্যোগ যেন বইকে করে তুলেছে আরও সহজলভ্য ও পাঠকসন্ধানি। এই স্বাধীন পাঠের চর্চা একজন শিক্ষার্থীকে কেবল পাঠকই নয়, মানবিকভাবেও সমৃদ্ধ করতে পারে।

এতসব আয়োজন থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চায় আগ্রহের সংকট ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ‘বইভব’ এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন, নবাগতরা জানেইনা এ-ব্যপারে। তেমন কোনো কার্যক্রমও নেই একে সক্রিয় করার জন্য বা নতুনদের যুক্ত করার জন্য। গাছে থাকা বাক্সে বই জমা হলেও খুব কম শিক্ষার্থী সেগুলো খুলে দেখে বা ধার নেয়। ধুলো জমে বই ও বাক্সে, ফিকে হয় বইয়ের চরিত্ররা। এই উদ্যোগ গুলো হয়ে উঠেছে একতরফা ভালোবাসা। যেখানে বইভব অপেক্ষা করে আছে তাকে ঘিরে আয়োজিত হবে সাহিত্য আলাপের আসর, আদানপ্রদান হবে বই। কিন্তু পাঠকের অভাবে এ ভালোবাসা থেকে যাচ্ছে নিঃসঙ্গ।

এই পাঠবিমুখতার পেছনে রয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের বিরূপ প্রভাব। সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের দ্রুত বিনোদনের যুগে ধীরস্থির হয়ে বই পড়া ও কল্পনা করে চরিত্র অনুভব করা যেন পরিশ্রমসাধ্য এক কাজ। অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়ার চেয়ে ফোন স্ক্রল করতেই বেশি আগ্রহী। সাহিত্য বা জ্ঞানভিত্তিক প্লাটফর্মগুলো আজকাল ‘ভিউ’ নির্ভর যুগে হয়ে পড়েছে সংকটপূর্ণ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবান নানান উদ্যোগ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনোযোগের বাইরে। গাছে বই আছে অথচ মনে সাহিত্যের কোনো চিহ্ন নেই। রিলসের চোখ ধাঁধানো আলোর নেশায় তারা পরিচিত হতে পারছেনা সাতকাহনের দীপাবলি বা গর্ভধারিনীর জয়িতার সাথে। তারা কখনও জানবে না দূর্গার জ্বর সারার অপেক্ষায় অপু কী ভীষণ অপেক্ষা করে গেছে ট্রেন দেখার।

বইভবের অতীতকথা ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান প্রভাষক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, “বিদ্যায়তনিক পরিসরে একাডেমিকের বাহিরে পাঠাভ্যাস তৈরির করার জন্য শুরু হয় বইভবের যাত্রা। শুরুতে এর উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মত। বই নিয়ে আড্ডা, কোনো টপিকের উপর ভিত্তি করে দীর্ঘ আলাপ ছিল সাধারণ দৃশ্য। এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধারা শুরু হয় কিন্তু দীর্ঘবিরতিতে তা বন্ধ এখন। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠের অভ্যাস, বই নিয়ে আড্ডার সংস্কৃতি কিছুটা কমে গেছে। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের বহুল ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে বইয়ের গন্ধ কিছুটা মলিন হয়েছে। বইভব সক্রিয় করা প্রয়োজন। বই সংগ্রহের নেশা ও নতুন নতুন লেখা পড়ার মাধ্যমে নিজের চিন্তাগত উৎকর্ষের দিকে মনোযোগ বাড়াতে বইভবকে জাগাতে হবে।”

গাছে গাছে ঝুলন্ত উন্মুক্ত লাইব্রেরির বইবাক্সে জমে আছে ধুলো। পাঠবিমুখতা থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা নিয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের ১৪তম আবর্তনের সুমাইয়া আক্তার শিমু বলেন, “বইপ্রেমীদের জন্য বইভব ও উন্মুক্ত লাইব্রেরির মতো প্ল্যাটফর্মগুলো নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ। বইপড়া শুধু জ্ঞান অর্জন নয়, এটা এক ধরনের আত্মিক শান্তি। পাঠকের হৃদয়ে বইয়ের প্রতি ভালোবাসাকে আরও গভীর করে তুলে এই প্লাটফর্মগুলো। নতুন পাঠকদের জন্য এগুলো একটা উন্মুক্ত জানালার মতো, যেখানে বইয়ের সঙ্গে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। তৈরী হয় পাঠের অভ্যাস। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে এসব মহৎ উদ্যোগ যথাযথ আগ্রহের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি প্লাটফর্মগুলো বাঁচিয়ে রাখা যায় তাহলে নতুন প্রজন্মকে আমরা আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো।”

এফকে/ আমেনা ইকরা

শেয়ার করুন -