প্রকৃতিতে হেমন্তের আগমন ঘটে নিরবে, নিভৃতে। ঘটা করে জানিয়ে সে আসে না। আকাশের গায়ে সাদা-নীলাভ বিস্তৃত রঙের প্রলেপ, আর তার নিচে সদ্য পাকা ধানের স্বর্ণালী আভা। এই আড়ম্বরহীন সাজই হেমন্তকে করে তোলে অপূর্ব। মনে হয়, প্রকৃতি যেন রঙতুলি দিয়ে আলো-ছায়ার ছবি এঁকে রেখেছে। বিস্তৃত সোনালি রোদ মেখে ধান মাড়াইয়ের খড়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে জানিয়ে দেয়—“আমি এসেছি।”
শহরের ব্যস্ত মেট্রোপলিটনে হেমন্ত প্রায় অদৃশ্য থাকে। ব্যস্ততা, যান্ত্রিক জীবনে রোজকার তাড়া—কিছুই দেখার ফুরসত হয় না। কিন্তু গ্রামের মানুষ চেনে হেমন্তকে। হাওয়ার এক হালকা বদল, বিকেলের কোমল আলো, ধানের দোলা—সব মিলিয়ে তারা বুঝে যায়, ঋতুকন্যা এসেছে। ধানের তেপান্তরে হাওয়া নাচতে থাকে, নদীর তীরে সূর্যের রোদ হেসে ওঠে, আর গ্রাম যেন এক নির্ভেজাল উৎসবের সাজ পায়।
কার্তিক–অগ্রহায়ণ মিলিয়ে জন্ম নেয় এই স্নিগ্ধ ঋতু। মধ্যযুগে বর্ষপঞ্জির শুরুও হতো হেমন্ত দিয়ে। সম্রাট আকবর ঠিক করেছিলেন, অগ্রহায়ণ হবে বছরের প্রথম মাস, খাজনা আদায়ের সময়। ধান পাকা মানে তখন শুধু কৃষিশ্রম নয়; আনন্দ, উত্তেজনা এবং নতুন বছরের প্রত্যাশা—সব মিলিয়ে ছিল এক উচ্ছ্বসিত আমেজ।
গ্রামবাংলার রূপ একসময় অন্যরকম ছিলো। মাঠে মাঠে ধান কাটার ব্যস্ততা, বাতাসে পাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধ, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা আনন্দের সুর—সব মিলিয়ে হেমন্ত যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। কবিরাও হেমন্তকে শুধু লিখেননি, ভালোবেসেছেন। সুফিয়া কামালের কলমে, রবীন্দ্রনাথের সুরে, জীবনানন্দের বিষাদে—হেমন্ত যেন প্রকৃতির মুচকি হাসি, সাধারণ অথচ গভীর।
একসময় ঘরে ঘরে নবান্ন হতো। নতুন ধান উঠলেই পেট আর মন—দুটোই ভরে যেত। পিঠা, পায়েস, ঢেঁকিছাটার ভাত… যেন এক ঘরের রান্না পুরো গ্রামের উৎসব হয়ে উঠত। সন্ধ্যার আলোয় শিশুদের খেলা, মাঠের মধ্যে দৌড়ঝাঁপ, আর ঘরের মধ্যে হাসি—সব মিলিয়ে ঋতুর আসল আনন্দ ফুটে উঠত।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী হাবিবা সিথী তার সেই শৈশব-হেমন্তের কথা বলতে গিয়ে যেন একটু থমকে যান। তিনি বলেন, “যার ঘরে প্রথম নতুন ধান রান্না হতো, তারা সবাইকে ডাকত। আমরা একসাথে বসে ভাত খেতাম। ধান কাটার পর মাঠে খেলতে খেলতে সন্ধ্যা হতো। এখন এসব নেই… আনন্দগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।” তার কণ্ঠে যেন সেই সন্ধ্যা আর হাসির স্মৃতি ভেসে ওঠে, যা এখন কেবল নস্টালজিয়া।
সালমানপুর গ্রামের কৃষক সলিমুল্লাহও স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আগে অগ্রহায়ণ মানেই ধান কাটা।সকালে চিড়া-মুড়ি খেয়ে মাঠে যাইতাম, সেই সুখ ছিল আলাদা। এখন তো সব বদলাইয়া গেছে, পিঠা কিনে খাইতে হয় বাইরে দোকান থেকে। আগের মতো ছয়টা ঋতুই তো দেখা যায় না, পরিবেশটাও আগের মতো নাই “।
তবু এখনও হেমন্ত আসে। নরম আলো, হালকা হাওয়া, সোনালি মাঠ নিয়ে। তার উৎসব আর আগের মতো ঘরভরা নয়, আলো আগের মতো উজ্জ্বল নয়, শৈশব তার ঘ্রাণ আগের মতো উপলব্ধি করে না। তবুও সে আসে। ঠিক সেই কোমল পদক্ষেপে। মনে করিয়ে দেয়, একসময় মানুষ, প্রকৃতি, ফসল আর উৎসব এক সমবেত সুরে বেজে উঠত। নরম সোনালি আনন্দে ভরে থাকত পুরো বাংলার হৃদয়।
কেএইচ/ জারিন তাসলিম, অঙ্কিতা ঐশি