MCJ NEWS

বিদেশে উচ্চশিক্ষা: অনুপ্রেরণা, চ্যালেঞ্জ ও পরামর্শ

বিদেশে উচ্চশিক্ষা—এ কথাটি আজ আর নতুন নয়। বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীর স্বপ্নের তালিকায় বহুদিন ধরেই জায়গা করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার নাম। আধুনিক গবেষণা সুবিধা, উন্নত ল্যাব, বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অর্জন আর নিজের দক্ষতাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষায় শিক্ষার্থীরা ছুটে যায় সীমান্তের ওপারে।

এই স্বপ্নযাত্রার বাস্তব রূপরেখা তৈরি হয় তথ্য সংগ্রহের ধাপ থেকেই। স্কলারশিপ, টিউশন ফি, লিভিং কস্ট, ভিসা প্রসেস সবই নির্ভর করে সত্য তথ্য, সঠিক প্রস্তুতি আর ব্যক্তিগত পরিকল্পনার ওপর। কিন্তু অসংখ্য কনসালটেন্সির বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন, ‘গ্যারান্টি ভিসা’ ধরনের প্রতিশ্রুতি কিংবা অসম্পূর্ণ তথ্য অনেক শিক্ষার্থীকে শুরুতেই ভুল পথে চালিত করে। বিশেষত যারা গবেষণা ভিত্তিক উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখে। তাদের জন্য সুপারভাইজার খোঁজা, গবেষণা প্রস্তাব লেখা বা ভাষাগত যোগ্যতা সবই নিজের মেধা ও প্রস্তুতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাই বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথ আসলে শুধুই আবেদন বা ভিসার প্রক্রিয়া নয়, এটি প্রস্তুতি, সিদ্ধান্ত এবং নির্ভরযোগ্য তথ্যের ওপর দাঁড়ানো এক দীর্ঘ ও সচেতন যাত্রা।

অনেক শিক্ষার্থী এসব তথ্য জানতে চাইলেও নির্ভরযোগ্য উৎসের অভাবে দ্বিধায় থাকে। সেই অজানা প্রশ্নের উত্তর আর বিভ্রান্তি দূর করতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে যত কথা বলেছেন বিভিন্ন দেশে অধ্যরনরত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা।

উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রাথমিকভাবে মনস্তাত্বিক প্রস্তুতি ও অনুপ্রেরণার বিষয়ে ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বর্তমানে অধ্যয়নরত গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আসমা ইসলাম বলেন,“আমি সবসময় পড়াশোনার সাথেই থাকতে চেয়েছি এবং একাডেমিক জীবনে দক্ষতা অর্জনের জন্য উচ্চশিক্ষা অপরিহার্য ছিল বলে আমি মনে করেছি এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে বিদেশে এসেছি।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের জন্য একা দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সহজ সিদ্ধান্ত নয়, আর আমার ক্ষেত্রে সেটা আরও চ্যালেঞ্জিং ছিল। পুরো জার্নিটাই আমি লড়েছি আমার মনোবল এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বড় স্বপ্ন থেকে। সংশয়, সম্ভাবনা, সবার সম্মতি আদায় এবং আর্থিক সক্ষমতা অর্জন ও শক্ত মানসিক অবস্থান সবকিছুই একসাথে সামলে উঠতে হয়েছে।”

আবেদন ও ভিসা প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব তুর্কু’তে অধ্যয়নরত কুবি’র রসায়ন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী শিহাব রহমান বলেন, “ কম CGPA নিয়েও আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে পুরো প্রক্রিয়া পরিচালনাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাকে শক্তিশালী ডকুমেন্ট প্রস্তুত করতে হয়েছে, নিজের প্রোফাইল উন্নত করতে হয়েছে, আর দীর্ঘ অপেক্ষার সময়গুলো ধৈর্য ধরে পার করতে হয়েছে। আমি নিজেকে বারবার লক্ষ্য মনে করিয়ে দিতাম এবং ধাপে ধাপে কাজ করতাম। প্রোগ্রাম রিসার্চ, IELTS প্রস্তুতি, ডকুমেন্ট সাজানো এবং আগেভাগে আবেদন করা।

কখনো হতাশা এসেছে, কখনো ভয়ের অনুভূতি। কিন্তু আমি নিজের শক্তিশালী দিকগুলোতে ফোকাস করেছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি পরিকল্পনা- মানেই শক্তি। নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখুন, প্রস্তুতিমাফিক কাজ করুন এবং পুরো প্রক্রিয়াটিকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন। কঠিন চ্যালেঞ্জও এইভাবে ধাপে ধাপে মোকাবিলা করা সম্ভব।”

ইউনিভার্সিটি অব হাডার্সফিল্ডের শিক্ষার্থী এবং কুবি’র ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক ছাত্র মোহাম্মদ হোসেন বলেন, “পরিবার থেকে দূরে থাকার শুরুটা মানসিকভাবে বেশ কঠিন ছিল। তবে এই অভিজ্ঞতাই আমাকে আরও দায়িত্বশীল, স্বনির্ভর ও পরিপক্ক করে তুলেছে।”

তিনি বলেন আরও বলেন, “এখানকার কালচার, নিয়ম–কানুন এবং একাডেমিক স্ট্রাকচার সবই বাংলাদেশের থেকে আলাদা, তাই শুরুতে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছে। এই দেশের মানুষরা খুবই অগ্রসর ও সহযোগিতাপূর্ণ, যার ফলে কোনো নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি। ক্লাস, বাসায় পড়াশোনা, প্রজেক্ট সবই একা সামলাতে হয় আর এই ব্যস্ততাই আমাকে আগের চেয়ে আরও বেশি ফোকাসড ও সংগঠিত হতে সাহায্য করছে।”

বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথটা প্রথমেই কারো কাছে এতো সুখকর হয় না। অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিতে গিয়ে অন্ধকারে হাতড়াতে হয়। তাই উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদের পথ কিছুটা মসৃন করতে রোসকিল্ড ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত কুবি’র লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সাম্মী আক্তার বিথী দেন কিছু পরামর্শ। তিনি বলেন, “ প্রথমত প্রচুর রিসার্চ করতে হবে অর্থাৎ লিস্ট করা কোন দেশে যেতে চান, কোন কোর্সে ওই দেশে কোন ইউনিভার্সিটি আপনার জন্য এপ্লিকেবল। প্রত্যেক ইউনির আলাদা ওয়েবসাইট থাকে, সেখানে গিয়ে কোন কোর্স চয়েজ লিস্টে রাখতে চান এবং ওই ইন্ডিভিজ্যুয়াল কোর্সে দেখতে হবে আপনি এপ্লিকেবল কি না। রিকুয়ারমেন্ট মিলে কি না। কোর্স ফি, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট কত পেতে হবে এগুলো রিসার্চ করে লিস্ট করা।

দ্বিতীয়ত, পেপার SOP, Reference letter, CV এই তিনটা জিনিস আপনার বাকিদের থেকে আলাদা করে রেডি করা। এগুলো সুন্দর করে লিখা লাগবে। সিভি ইন্টারন্যাশনাল ফরম্যাট মেইনটেইন করে লিখা।
সর্বশেষে মানসিকভাবে প্রিপারেশন নেওয়া। অন্য দেশে আসার পরে শুরুটা সুন্দর নাও হতে পারে। অনেক স্ট্রাগল করতে হতে পারে। নেগেটিভ কিছু আসলে সেটার জন্য আগে থেকে প্রিপারেশন নেওয়া। ভালো রাখার জন্য মানসিকভাবে প্রিপারেশন নেওয়া জরুরি।”

বিদেশে উচ্চশিক্ষা শুধু ভালো একটি ডিগ্রি পাওয়ার বিষয় নয়, এটি নিজেকে মানসিকভাবে গড়ে তোলার একটি প্রক্রিয়া। শুরুতে কষ্ট, ভয় ও অনিশ্চয়তা থাকলেও সঠিক তথ্য, ধৈর্য আর আত্মবিশ্বাস থাকলে সেগুলো মোকাবিলা করা যায়। ধাপে ধাপে প্রস্তুতি নিলে পথটা সহজ হয়। নিজের সক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখলে এই যাত্রা একসময় সফলতার গল্প হয়ে ওঠে।

এফকে/ ডওয়াংনুং, সুস্মিতা, হাসিন

শেয়ার করুন -