MCJ NEWS

স্বর্গরাজ্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: সমস্যাহীন ক্যাম্পাসের এক অনন্য গল্প

প্রতিদিন সকালে যখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন মহোদয়গণ তাদের দপ্তরের জানালা দিয়ে তাকান তখন তাদের চোখে পড়ে এক নিখুঁত, সুসজ্জিত, সমস্যাহীন শিক্ষার ইউটোপিয়া। আজ আমরা সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ক্যাম্পাসের বাস্তব চিত্র দেখবো।

শুরুতেই ক্যাম্পাসের বাস সংকটকে বলা যায় ‘অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম’। শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস সংকট তো না! এটা একটি পূর্ণাঙ্গ ‘অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম’ যাত্রা। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা যে দৌড়-ঝাঁপ, ধাক্কাধাক্কি আর মাসল পাওয়ারের জোর দেখাতে হয়, তা তাদের শারীরিক সক্ষমতা ও কৌশলী চিন্তাশক্তি বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখে। এটিকে বলা চলে ফ্রি অফ-কারিকুলাম এক্টিভিটি, যা তাদের জীবনকে করছে আরও গতিশীল ও সমৃদ্ধ। আর লাল বাসের নিয়মিত মেকানিক শপ ভিজিট শিক্ষার্থীদের জন্য হাতে-কলমে কারিগরি শিক্ষার এক অনন্য সুযোগ।

অন্যদিকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটকে সমস্যা ভাবছেন? এই সংকট তো শিক্ষার্থীদের আরও স্বাধীন ও স্বনির্ভর করে তুলেছে। কুবির শিক্ষার্থীরা মস্ত বড়লোক। মেস-বাসার তো আর সংকট নেই। সেখানে তারা আরও স্বাধীনভাবে দিন কাটাচ্ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি বিনাবেতনে চাকরি জুটে যাচ্ছে মিল ম্যানেজার হিসেবে। এসব চিন্তা করেই প্রশাসন আবাসিক সংকটকে ‘স্বাধীন আবাসন সংস্কৃতি’ হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছে।

ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণ হলো ‘প্যাশেন্স অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’র বাস্তব ব্যবহারিক চর্চা। ফলাফল হিসাবে শিক্ষার্থীরা সরাসরি ভোট দিয়ে নেতা বাছাইয়ের চেয়ে পরোক্ষভাবে শত শত নেতা পাশে পাচ্ছে। এতে করে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতিও টিকে থাকবে, শিক্ষার্থীদেরও ন্যায্য দাবিতে নেতার অভাব হবে না।

আর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা কোনো আবর্জনা নয়, বরং আধুনিক ‘ইকো-আর্ট’। এটি শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে যে প্রকৃতির সাথেও শিল্পের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই ‘আর্ট ইন্সটলেশনগুলো’ সবার কাছে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিল্পবোধও তৈরি করছে।

হলের ডাইনিং ও ক্যাফেটেরিয়ার খাবার সবার জন্য প্রকৃত ‘ডায়েট প্ল্যান’। আর ক্যাফেটেরিয়ার ভাতের সাইজ যেন এক মস্ত কোলবালিশ! অবশ্য খাবারের ভিতর মাঝে মাঝে যে অতিরিক্ত প্রোটিন (পোকা) পাওয়া যায়, তা জৈব প্রোটিনের উৎস। এটাকে ইউএনডিপি ও এফএও এর কৃষি বিপ্লবের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যা শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর চাহিদা পূরণের জন্য ক্যাফেটেরিয়া আর হলের খাবারের তালিকায় সংযোজন করা হয়েছে।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক সংকট তো শিক্ষার্থীদের জন্য স্ব-শিক্ষা চর্চার উৎসাহ প্রদান করছে। তাই এই শিক্ষক সংকটই ‘স্বাধীন জ্ঞানান্বেষণের সুবর্ণ সুযোগ’। শিক্ষার্থীরা এখন নিজেরাই নিজেদের পথপ্রদর্শক, গবেষক। বরং এটি বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে ‘সেলফ-লার্নিং’ মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত কমিটি তো একটি স্থায়ী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কোনো ঝামেলা, দূর্ঘটনা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি গঠন এবং তার রিপোর্ট কখনো না আসা, এটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমৃদ্ধ ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে’ পরিণত হয়েছে। এটি শিক্ষার্থীদের শেখায় যে, প্রক্রিয়াটাই আসল ফলাফল নয়।

লাইব্রেরিতে বই সংকটের ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে চ্যাপজিপিটি আর গুগলিং দক্ষতা। লাইব্রেরিতে বইয়ের সংকট আমাদেরকে ডিজিটাল যুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন অনলাইন রিসোর্স অনুসন্ধানে আরও দক্ষ হয়ে উঠছেন। এটি একটি বাধ্যতামূলক ডিজিটাল শিক্ষার অংশ।

সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসজুড়ে আলোর সল্পতা শিক্ষার্থীদের জন্য রোমান্টিক আবহ। অন্ধকারে ক্যাম্পাসের পরিবেশে চলাচল সবাইকে আরও সচেতন করে তোলে। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর চিন্তা ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের পরিবেশ গড়ে তুলছে।

শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট বিলম্বিত হওয়া পেশাদার জীবনের প্রস্তুতির জন্য বড় শিক্ষা। রেজাল্ট পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তব জীবনের হাতে-কলমে শিক্ষা। কর্মজীবনে যেমন বেতন, প্রমোশন, সবকিছুতেই প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ও শিক্ষার্থীদের সেই কঠিন বাস্তবতার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি দিয়ে রাখছে।

স্পষ্টতই, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া, এটি জীবনবোধের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এখানে যা কিছুকে আপনি ‘সমস্যা’ বলে ভাবছেন, তা আসলে প্রশাসনের সুচিন্তিত ‘ফিচার’।

কেউ যদি বলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা আছে, আপনি হেসে উড়িয়ে দেবেন। কারণ এই স্বর্গরাজ্যে সমস্যা নামক জিনিসটির অস্তিত্বই নেই। আছে শুধু অসীম সম্ভাবনা আর ‘ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি’র অপার মহিমা।

এসএ/ মেহের আফরিন

শেয়ার করুন -