MCJ NEWS

আপন পথে পথচলা: স্বপ্নবাজদের গল্প

চাকরির নিরাপদ গণ্ডির বাইরে পা রাখলেই যে পথটা শুরু হয়, সেটার নাম অনিশ্চয়তা। কিন্তু সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নিজস্ব আলোয় উজ্জ্বল হওয়ার এক অদ্ভুত টান। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ঠিক সেই টানটাকেই বিশ্বাস করেছেন। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট আর পরীক্ষার ফাঁকে তারা জীবনকে দেখেছেন অন্য চোখে।কারও শখ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে উদ্যোগ, কারও কাছে ভোগান্তিই জন্ম দিয়েছে সমাধানের ভাবনা। সীমিত সামর্থ্য, সময়ের চাপ আর সমাজের সন্দেহকে পেছনে ফেলে তাঁদের এই পথচলা মনে করিয়ে দেয়—উদ্যোক্তা হওয়া মানে নিজের ইচ্ছে এবং ভাবনায় সাহসের সঙ্গে বিশ্বাস রাখা।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৫তম আবর্তনের শিক্ষার্থী মোঃ শহিদুল ইসলামের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্পটা ছিলো বাস্তব চিন্তার মিশেল। তাঁর উদ্যোগের শুরু খেজুর, আতরের ব্যবসা দিয়ে। স্মৃতির পাতায় ফিরে তিনি বলেন, “২০২২ সালে ভর্তির জন্য ভাইবা দিতে গিয়েছিলাম পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে ভাইয়ের কাছে ছিলাম, তাকে ব্যবসা করতে দেখেছি। ওখান থেকেই ব্যবসার আইডিয়া আসে।” সেই ভাবনাই পরে বাস্তবে রূপ নেয় ২০২৪ সালের রমজানে, যখন তিনি নিজ উদ্যোগে খেজুর আতরের ব্যবসা শুরু করেন।

ব্যবসার পথে সবচেয়ে বড় লড়াই ছিল নিজের মনকে সামলে রাখা। মানুষের কথা, চারপাশের দৃষ্টিভঙ্গি—সব মিলিয়ে মানসিক চাপ তৈরি হয়। তবে এই জায়গাতেই নিজের অবস্থান পরিষ্কার রেখেছেন শহিদুল। তিনি বলেন, “ধৈর্য ধরে রাখা আর মানুষ কী ভাবছে এই চিন্তাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।আলহামদুলিল্লাহ, এক্ষেত্রে আমার সমস্যা হয়নি। মানুষ কী ভাবছে আমি আমলে নেই না।” এই আত্মবিশ্বাসই তার যাত্রার সবচেয়ে বড় শক্তি।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সামিয়া নাজ স্বীকৃতির উদ্যোগের শুরুটা ছিল একেবারেই শখ থেকে। হাতে তৈরি গহনা আর হ্যান্ডপেইন্টেড নানা সামগ্রী বানানোর ভালোবাসা থেকেই তার পথচলা। আইডিয়া খোঁজার ক্ষেত্রেও তিনি নিজেকে আটকে রাখেননি কোনো এক জায়গায়। তার কথায়, “অনলাইনে অন্যদের ভিডিও দেখে আইডিয়া নেই, আবার নিজেও চিন্তা করি।”শুরুতে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না, তবু স্বীকৃতির কাজ সাড়া ফেলেছিল ভালোই। বর্তমানে সাময়িক বিরতিতে থাকলেও এই বিরতিকে তিনি থামা হিসেবে দেখছেন না। বরং ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবেই দেখছেন। সামিয়া বলেন, “এভাবে শুরু করেছিলাম, ভালো সাড়া পাব তা ভাবিনি। এখন আপাতত একটু বিরতি নিয়েছি, তবে এটাকে শেষ মনে করি না। পরে আবারও পুরো দমে শুরু করব। ভবিষ্যতে ব্যবসাকে আরও বাড়ানোর ইচ্ছা আছে।”

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৭তম আবর্তনের শিক্ষার্থী জারিন তাসলিমের উদ্যোগের গল্পটা জন্ম নিয়েছে প্রকৃতির কাছ থেকে। বন্ধু আর সিনিয়র আপুদের উৎসাহে তার এই ছোট্ট ব্যবসার শুরু। চুড়ির রং আর নকশার পেছনে প্রকৃতিই জারিনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তিনি বলেন, “চুড়িতে রং আর ডিজাইনের আইডিয়াগুলো পাই প্রকৃতি থেকে। আশেপাশের অসংখ্য রঙের সংমিশ্রণ দেখে অনুপ্রাণিত হই, আর সেগুলোই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি আমার চুড়িতে।” আপাতত বড় পরিসরে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও ক্যাম্পাসের ভেতরেই শখটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান তিনি। তিনি বলেন, “ছোট পরিসরে ক্যাম্পাসেই পরিচালনা করতে চাই, যেন আমার শখটাও কন্টিনিউ করতে পারি, আর ক্যাম্পাসের আপুদের রিজনেবল প্রাইজে সুন্দর চুড়ি উপহার দিতে পারি।”

ক্যাম্পাস জীবনের একেবারে বাস্তব সমস্যা থেকেই জন্ম নিয়েছে আরেকটি উদ্যোগ—‘ফুড বক্স ডেলিভারি সার্ভিস’। মার্কেটিং বিভাগের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোঃ রাকিব ও তাসনিম কাদের ইরফান যৌথভাবে এটি পরিচালনা করছেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ইরফান বলেন, “ক্যাম্পাসে আসার পর আমি নিয়মিত খাবার নিয়ে সমস্যায় পড়তাম। হলের খাবার মানিয়ে নিতে পারছিলাম না, বাইরে খেলে খরচ সামর্থ্যের বাইরে চলে যেত। আমি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তাই পরিবারকে বাড়তি চাপ না দিয়ে নিজের খরচ নিজে চালানোর চিন্তাটা খুব কাজ করত।” রাকিবের অভিজ্ঞতাও একই জায়গায় এসে মেলে। তিনি বলেন, “হল বা মেসে থাকা ছাত্রদের খাবার নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকে… তখনই মনে হলো ছাত্রদের জন্য ঝামেলাহীন, সাশ্রয়ী একটা খাবার সার্ভিস দরকার।”

শুরুতে পরিবার থেকে আপত্তি থাকলেও সময়ের সঙ্গে সেই বাধা কেটে গেছে। ইরফান বলেন, “খাবারের ব্যবসায় সময়মতো ডেলিভারি সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। শুরুতে পরিবার ভয় পেয়েছিল। তবে এখন সবাই মানসিকভাবে পাশে আছে।” এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে দু’জনই দেখছেন তাদের পার্টনারশিপকে। ইরফানের কথায়, “রাকিব না থাকলে হয়তো আইডিয়াটা শুধু মাথায়ই থাকত। নিজের লাভের কথা ভেবে একা চললে অনেক আইডিয়া বাস্তবে আসে না।”

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তরুণ উদ্যোক্তাদের গল্পগুলো আলাদা হলেও একটি জায়গায় এসে মিলেছে—নিজের বাস্তবতা থেকে শেখা এবং সেই বাস্তবতাকে বদলানোর চেষ্টা। কারও গল্পে ধৈর্য, কারও গল্পে বিরতি, কারও গল্পে শিল্পবোধ, আবার কারও গল্পে সমস্যার সমাধান। সব মিলিয়ে এগুলো শুধু উদ্যোগের গল্প নয়; এগুলো নিজের জায়গা থেকে কিছু করার সাহসী এবং অনুপ্রেরণার গল্প।

কেএইচ/উম্মে হাবিবা মৌ

শেয়ার করুন -