ইতিহাস সাক্ষী—কোনো শক্তিই চিরকাল স্থায়ী নয়।রাজারাজড়ার রাজত্ব, জৌলুশে ভরা রাজপথ, সভ্যতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শহর—সব কিছুই একসময় মিলিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়। ধুলোয় ঢাকা ধ্বংসস্তূপের নিচে লুকিয়ে থাকে গৌরবের গল্প, বেদনার ছায়া আর হাজারো না-বলা কথা।
সময়ের প্রবাহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ, বা অভ্যন্তরীণ পতনের ফলে শক্তিধর শহর আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। এজন্যই হয়তো রোমান কবি ওভিড বলেছিলেন, “সময় সবকিছুকে থামিয়ে দেয়, কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয় — এমনকি বড় শহরগুলোও এর বাইরে নয়।”
যেমনভাবে যুগে যুগে বিলীন হয়ে গেছে পেট্রা, মাচুপিচু কিংবা ট্রয়ের মতো শক্তিশালী নগরগুলো। কখনও আগ্নেয়গিরির গর্জনে, কখনও নদীর পথ হারিয়ে ফেলা জলে, আবার কখনও নিঃশব্দ অভিমানে হারিয়ে গেছে তারা। কিছু শহর রয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়, আবার কিছু হারিয়ে গেছে চিরতরে। আজ এমসিজে নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেইসব হারিয়ে যাওয়া শহরের গল্প, যারা ধ্বংস হয়েও হারিয়ে যায়নি—রয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।
জাদুকরী শহর “মহেঞ্জোদারো”
একটা সময় ছিল, যখন সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এক বিস্ময়কর নগরী—মহেঞ্জোদারো। আজকের পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের মাটির নিচে ঘুমিয়ে ছিল এই শহর। বছরটা ১৯২২। প্রত্নতত্ত্ববিদ আর. ডি. ব্যানার্জির কুঠারির কোপে যখন মাটি খুঁড়ে বের হয়ে আসে ইটের তৈরি নিখুঁত গলি, বিস্ময়ে থমকে যায় সারা বিশ্ব। কী চমৎকার পয়ঃনিষ্কাশন! কী পরিপাটি রাস্তা! আর শহরের মাঝে সেই বিখ্যাত ‘গ্রেট বাথ’—এক বিশাল পুকুর, যেন কোনো প্রাচীন স্পা!
কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, এত সব জৌলুশের ভিড়ে নেই কোনো রাজপ্রাসাদ কিংবা বিশাল মন্দির। যেন সবাই ছিল সমান। কারো ওপরে কেউ নয়। তবে সে নগরী আর নেই। কীভাবে হারিয়ে গেল, তা আজও রহস্য। কেউ বলেন নদী পথ বদলেছিল, কেউ বলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আবার কেউ বলেন—সময়ের নিয়মেই একদিন থেমে যায় সব।
হারিয়ে যাওয়া রাজপ্রাসাদ “মাচু পিচু”
আন্দিজ পর্বতমালার গা ঘেঁষে, ৮,০০০ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ছিলো এক রাজপ্রাসাদ নগরী—মাচু পিচু। পেরুর হৃদয়ে নির্মিত এই নগরীর বয়স আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের। বহুকাল আড়ালে থাকা এই শহরের খোঁজ মেলে ১৯১১ সালে, মার্কিন অভিযাত্রী হিরাম বিংহ্যামের হাতে।
মাচু পিচু যেন প্রকৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর এক অভূতপূর্ব সম্মিলন। ধাপে ধাপে সাজানো কৃষিজমি, সূর্যদেবের উপাসনাস্থল, আর ইনকা রাজাদের রাজকীয় বাসভবন—সবই সাক্ষ্য দেয় এক গৌরবময় অতীতের।ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এটি হয়তো ইনকা শাসকদের অবকাশযাপনের স্থান ছিলো, অথবা কোনো পবিত্র ধর্মীয় তীর্থস্থল।
তবু কেন হারিয়ে গেল এই আশ্চর্য নগরী? বিস্ময়করভাবে, স্প্যানিশ উপনিবেশবাদীদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো এই শহর। ধারণা করা হয়, স্প্যানিশদের আগমনের আগেই কোনো অজানা কারণে পরিত্যক্ত হয়ে যায় এটি। আর এই আড়ালেই রয়ে গিয়েছিলো এর সৌন্দর্য, প্রায় অক্ষত অবস্থায়।
আজ মাচু পিচু শুধুই এক পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং অতীতের এক নিঃশব্দ জিজ্ঞাসা—কীভাবে গড়ে ওঠে, আবার হারিয়েও যায় এক সভ্যতার চূড়ান্ত কীর্তি
পাপের শহর “পম্পেই”
অনেকেই একে বলে অভিশপ্ত শহর। পম্পেই ছিলো প্রাচীন একটি রোমান শহর যা ইতালির নেপলসের কাছাকাছি অবস্থিত ছিলো।
পৃথিবীর প্রাচীনতম জনপদগুলোর একটি ছিলো এই পম্পেই নগরী। শহরটির এক পাশে ছিলো সমুদ্র, অপর দিকে সবুজ ভেসুভিয়াস পাহাড় ও বিশাল আকাশ।আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭ম-৬ষ্ঠ শতকে, সম্ভবত গ্রিক ও ইতালিক জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা তৈরি হয়েছিলো শহরটি।প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি ছিল এ নগরটি। সে সময়কার পৃথিবীর সব থেকে সুখী নগরী ছিল এটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যেমন এই নগরী ছিলো ভরপুর, ঠিক তেমনি এই নগরীর মানুষের জীবনব্যবস্থা ছিলো বর্বর। নগ্নতা, যৌনতা, সমকামীতা ছিলো তাদের পেশা। মনে করা হয় তাদের এই পাপের আগুনেই ধ্বংস হয়েছে এই শহর। ঈশ্বরের অভিশাপে একদিনেই ছাইয়ে পরিণত হয় এই শহর।
৭৯ খ্রিষ্টাব্দের কথা। অন্যান্য দিনের মতোই একটা স্বাভাবিক দিন ছিলো নগরীর মানুষদের জন্য। হঠাৎ করেই জেগে উঠেছিল ভিসুভিয়াস পর্বতের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। মাত্র ১৮ ঘণ্টায় পুরো পম্পেই ঢাকা পরে গিয়েছিল আগ্নেয়গিরির লাভায়। হাজার হাজার মানুষ জীবন্ত অবস্থায় সেই লাভায় ঢাকা পড়েছিল। আগ্নেয়গিরির লাভায় হারিয়ে যায় অভিশপ্ত শহর পম্পেই। এর পরবর্তী ২ হাজার বছর এই শহর ছিলো লোকচক্ষুর আড়ালে। ১৫৯৯ সালে এই শহরের সন্ধান পান ডমিনিক ফোন্তানা। তারপর ধীরেধীরে পুনরুদ্ধার করা শুরু হয় হারিয়ে যাওয়া এই নগরীকে। খুজে পাওয়া যায় হাজার হাজার মৃত দেহ, সেইসময়কার চিত্রকর্ম, দালান, ভাস্কর্য। এতো বছর পরও যার অনেক কিছু এখনও রয়েছে অক্ষত। পম্পেই যেন আজও ফিসফিস করে বলে, “আমি হারাইনি, আমি শুধু থেমে গেছি।”
হারানো সাম্রাজ্যের নাম “ট্রয়”
এক সুন্দরী নারীর প্রেমে ধ্বংস হয়েছিলো একটি সাম্রাজ্য—এমনই এক উপাখ্যান বয়ে বেড়ায় প্রাচীন নগরী ট্রয়।ট্রোজান যুদ্ধ, হেলেনের সৌন্দর্য, অ্যাকিলিসদের বীরত্ব, গ্রীকদের ধূর্ততা, ট্রয় নগরী শুধুই কি উপকথা নাকি সত্যি? তুরস্কের উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ায় অবস্থিত এই শহরটির কথা আমরা পাই গ্রিক মহাকবি হোমারের “ইলিয়াড” ও “ওডেসি” মহাকাব্যে। ধারণা করা হয়, ট্রয় নগরীর শুরু খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ সালের দিকে, ব্রোঞ্জ যুগে।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ত্ববিদদের খননে ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয় এই হারানো শহর। তখনই গ্রীক পুরাণ থেকে বাস্তবে রুপ নেয় এই ট্রয় নগরী। যা অনেককে বিশ্বাস করায়—হোমারের উপাখ্যান নিছক কল্পনা নয়।
ট্রোজান যুদ্ধের সূত্রপাত রাজপুত্র প্যারিসের হাতে স্পার্টার রানি হেলেন অপহরণের মধ্য দিয়ে। মেনালাউস স্ত্রী ও সম্মান রক্ষায় গ্রীকদের নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ট্রয়ের বিরুদ্ধে। দশ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে গ্রীকদের কৌশলে—একটি কাঠের ঘোড়া, যেটি ছিল যুদ্ধজয়ের চাবিকাঠি। “ট্রোজান হর্স” ইতিহাসের অন্যতম ধূর্ততার প্রতীক হয়ে আজও স্মরণীয়।
ট্রয় নগরীর ইতিহাস সত্যি নাকি উপকথা এটা নিয়ে এখনো মানুষের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। হোমারের বর্ণিত এই গল্পের সত্যতা বর্তমান পৃথিবী জানে না। কিন্তু ট্রয় এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনাতোলিয়ার মাটিতে।
সময়ের সঙ্গে শহরগুলো আজ হারিয়ে গেছে। তবু তারা রয়ে গেছে—ইটের ভাঙা দেয়ালে, পাথরে খোদাই হওয়া রেখায়, আর মানুষের বিস্ময়ভরা চোখে। তারা মনে করিয়ে দেয়—উত্থানের গর্ব যেমন থাকে, তেমনি পতনের শিক্ষাও প্রয়োজন। কারণ, ইতিহাসের পাঠ না নিলে পরিণতিটা হয় অমোঘ। সময় থেমে থাকে না, কিন্তু স্মৃতি থেকে যায়।
এএম/মেহের আফরিন লাইফা, নিশাত তাসনিম অহনা