MCJ NEWS

‘লাল রঙেই বলেছিলাম, আর চুপ থাকব না’

হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত নীরবতা ভেদ করে জেগে ওঠে একটি রঙ -লাল। শহরের ব্যস্ত রাস্তা নয়, গ্রামের হাটও নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। অনলাইন হয়ে ওঠে যুদ্ধক্ষেত্র, ফেসবুক ছিল ব্যারিকেড, আর প্রোফাইল পিকচার? সেটিই হয়ে ওঠে প্রতিবাদের অদৃশ্য লাল পতাকা। কেউ কিছু বলেনি, শুধু একটি রঙ! আর সেই রঙেই উচ্চারিত হয়েছিল ক্রোধ, প্রতিরোধ এবং দীর্ঘদিনের বৈষম্যের সংগঠিত স্বর।

হাজারো মানুষ একে একে লাল করে ফেলেছিল তাদের প্রোফাইল। সেই লালের ভেতর ছিল হাহাকার, ছিল সম্মিলিত এক চিৎকার, যা ভাষায় লেখা হয়নি, তবু প্রতিটি চোখে, প্রতিটি স্ক্রলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারিকুল ইসলাম নিলয় সেই সময়টিকে স্মরণ করে বলেন, “যখন দেখলাম সবাই ফেসবুক প্রোফাইল লাল রঙে রাঙিয়েছে, মনে হয়েছিল এই তো একতা, আমরা সবাই একসাথে। পৃথিবীতে লাল রঙের অনেক অর্থ আছে, যুগে যুগে এসব অর্থ সময়ের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনই, জুলাই আন্দোলনে লাল প্রোফাইল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা, স্বৈরাচার রুখে দাঁড়ানোর ভাষা। নিঃশব্দে সবাই যেন একত্রে বলে দিচ্ছিল, আমরা আর চুপ থাকব না। মনে হয়েছিল একটা আশা জেগে উঠেছে।”

নিজের প্রোফাইল লাল করার স্মৃতি তুলে ধরে নিলয় বলেন, “আমি আমার প্রোফাইল লাল করেছিলাম শুধু একাত্মতা প্রকাশের জন্য নয়, এটা ছিল নীরব প্রতিবাদের ভাষা। বলতে চেয়েছিলাম, আমি অন্যায় দেখছি, আমি অন্যায়ের শিকার, আমি আর চুপ করে থাকব না। নিজের অনেক বন্ধু, জুনিয়রকে স্বৈরাচার বাহিনীর হাতে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখেছি। দেশের অসংখ্য মানুষ তখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল আমার বয়সী। তারা আমার ভাই। নিজের শরীরের রক্তও যেন বলে উঠেছিল, আর নয়। তাই লাল প্রোফাইল ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ছোট্ট কিন্তু দৃঢ় এক পদক্ষেপ।”

এই লাল রঙ যেন একেকটি হৃদয়ের প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার কেয়া সেই সময়ের চিত্রই যেন তুলে ধরলেন, “সত্যি বলতে, যে সময়টায় আমরা অধিকারের লড়াইয়ে আমাদের ভাইকে হারিয়েছি, সেই সময় প্রতীকী এই লাল প্রোফাইলকে বেছে নিয়েছিলাম প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। তখন স্বৈরশাসকের প্রতি ঘৃণা এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, স্বৈরাচারের পোষ্য নেতারা আমাদের ক্ষতি করবে কিনা সেই ভয়টাও পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল। ঘৃণার তীব্রতায় মৃত্যুভয় ঠুনকো লাগছিল। মনে হয়েছিল, রাস্তায় যে ভাইবোনটা প্রাণ দিয়েছে, তার জন্য এই প্রতিবাদটুকু করতেও যদি দ্বিধা করি, তবে আমার আর একজন মীরজাফরের মাঝে পার্থক্য কোথায় রইল।”

জুলাইয়ের সেই দিনগুলো মনে গেঁথে রাখা কুবির শিক্ষার্থী মো. আসিফ বলেন, “জুলাইয়ের ছাত্রজনতার আন্দোলনে তৎকালীন সরকারের সরাসরি আদেশে পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাবসহ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের সদস্যরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছিল। প্রতিদিনই শতাধিক মানুষ শহীদ হচ্ছিলেন, আহত হচ্ছিলেন সহস্র। আমাদের ভাইবোনদের রক্তে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল লাল, আর তারই প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল লাল প্রোফাইল পিকচার। ২৪-এর আন্দোলন ছিল পুরোপুরি সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর। বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, গ্রুপ, টাইমলাইন, চ্যানেলে আন্দোলনের সময়, স্থান ও আপডেট পেতাম। কীভাবে আমাদের ভাইদের হত্যা করা হচ্ছে, কীভাবে তারা অন্যায়ের পিস্তলের সামনে বুক পেতে গুলি খাচ্ছে, তা দেখে শরীরে বিদ্রোহ জেগে উঠত। বারবার ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলনের গতি থামাতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের এক নতুন, তীক্ষ্ণ অস্ত্র।”

এই আন্দোলন শুধু তরুণদের ছিল না, শিক্ষকরাও ছিলেন এর সঙ্গে, কেউ সরবভাবে, কেউবা নীরবে। তেমনই একজন ড. কামরুন নাহার শিলা, যাঁর নিজের সন্তানও ছিলেন আন্দোলনের সক্রিয় একজন। তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, লাল প্রোফাইল ছবি সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন পেশাজীবীদের মানসিকভাবে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। যারা রাস্তায় নামতে পারেননি, তারাও এই প্রতীকের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছিলেন। এটি ছিল এক ধরনের নীরব এবং দৃশ্যমান প্রতিবাদ, যা সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আন্দোলনটি কেবল শারীরিক নয়, বরং একটি সামষ্টিক প্রতীকী সংহতির রূপ নেয়।”

ড. শিলা বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, “এটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদের একধরনের সাইবার রেজিস্ট্যান্স। লাল প্রোফাইল ছবি ছিল ভয়কে অস্বীকার করার সাহসী এক অভিব্যক্তি। এটি দেখিয়েছিল, প্রতিবাদ শুধু রাস্তায় নয়, ডিজিটাল পরিসরেও শক্তিশালীভাবে হাজির হতে পারে।”

২০২৪ সালের জুলাই শুধু একটি মাস ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল এক মানসিক অবস্থার নাম। সেই মনোভাব থেকেই জন্ম নেয় এক নতুন নাগরিক চেতনা। যারা বুঝে গিয়েছিল, নীরব থাকাও একপ্রকার অপরাধ। আর ফেসবুক প্রোফাইলের সেই লাল রঙ, সেটি ছিল না শুধুই একটি ছবি, ছিল বিপ্লবের ডাক।

কেএইচ/মনিরা আক্তার শিলা

শেয়ার করুন -