MCJ NEWS

আত্মার স্বাক্ষর কণ্ঠ

কণ্ঠ—কেবল কথা বলার যন্ত্র নয়, বরং অনির্বচনীয় আবেগের কারাগারও, যেখানে জমে থাকে অব্যক্ত অনুভূতি। যখন মুক্তি পায়, তখন তা হয় কুয়াশাভেজা সকালের কোমলতা বা নিকষকালো তীব্র বিভীষিকা। কী বলছি, আর কী বলছি না—এই ‘নীরবতা ও উচ্চারণ’-এর দ্বন্দ্বেই গড়ে ওঠে আমাদের চারপাশের বাস্তবতা।

কণ্ঠের গুরুত্ব ও সৌন্দর্য উদযাপন করতেই প্রতিবছর ১৬ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব কণ্ঠ দিবস। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলে চিকিৎসক, শিল্পী ও গবেষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যার সূচনা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে অনুধাবন করানো, আমাদের কণ্ঠের যত্ন নেওয়া কতটা জরুরি। আজ আমরা শুনব এমন কিছু কণ্ঠের গল্প—যারা কণ্ঠকে শুধু ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি নয়, বরং দায়িত্ব, প্রতিবাদ ও স্বপ্নপূরণের মাধ্যম হিসেবে দেখেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী শেখ সাইফ আহমেদ আফ্রিদি শৈশবে টিভির গান শুনে গুনগুন করতেন। আজ তার কণ্ঠে বেজে ওঠে সংবেদনশীল নাট্য-সংলাপ। তিনি বলেন, “কণ্ঠ কেবল কথা বলার মাধ্যম নয় এই উপলব্ধি আমি শৈশবেই পেয়েছি। কণ্ঠের ছন্দ, গতি ও শৈল্পিকতা মন ভালো করার শক্তি রাখে, মুগ্ধ করে। এ এক অদ্ভুত অস্ত্র।” নিজের কণ্ঠের যত্ন প্রসঙ্গে জানান, “আমি চিৎকার করে কথা বলি না। থিয়েটারে উচ্চস্বরে বলতে হয়, তবে তা নির্দিষ্ট স্কেল মেনেই, যাতে কণ্ঠের ওপর চাপ না পড়ে। রেওয়াজ, সারগম ও কিছু যোগা করি, সব মিলিয়ে কণ্ঠ নিজের মতো শানিত করি।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিমাদ্রী কণ্ঠকে দেখেন অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে—যেখানে কণ্ঠ কেবল শিল্প নয়, প্রতিবাদের ভাষাও। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার কাজ কণ্ঠ নিয়ে, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় অনুভব করি শুধু গৎবাঁধা আবৃত্তি করা নয়, বরং এমন কিছু করা উচিত যেন চুপ থাকা মানুষের কণ্ঠ হয়ে ওঠা যায়। ‘সিক্সটিন ডেইস অফ ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট’-এর অংশ হয়েছি, সেখানে তাদের হয়ে কথা বলতে পেরেছি। যাদের কণ্ঠস্বর বাজেয়াপ্ত রাখা হয়, তাদের আওয়াজ হয়ে ওঠাই আমার কণ্ঠের ব্রত। এই ইচ্ছে আমার আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।”

রুবাইয়াত তাজবীন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং অনুপ্রাস কণ্ঠচর্চা কেন্দ্রের সভাপতি। তার কণ্ঠ শুধু শব্দের বাহন নয়, বরং নিজের ভাঙচুর ও পুনর্গঠনের সাক্ষ্যও। বছর দুয়েক আগে জীবনের এক কঠিন সময় পার করছিলেন তিনি। হঠাৎ একদিন এক জুনিয়র তাকে উপহার দেয় একটি ব্যাগ, নিজ হাতে খুব যত্নে আঁকা। তিনি জেনে অবাক হন যে উপহারটা এসেছে তার কণ্ঠের টানে। এক আড্ডায় তিনি বলেছিলেন, “তুমি তো খুব সুন্দর পেইন্ট করো।” কথাটা এমনভাবে হৃদয়ে গেঁথেছিল যে মেয়েটি তৈরি করে এনেছিল এই উপহার। রুবাইয়াত বলেন, “সে মুহূর্তেই আমি বুঝেছিলাম আমার কণ্ঠ কেবল শব্দ নয়, কারো কাছে ভালোবাসা, আশ্রয় এবং অনুপ্রেরণাও। আমি ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাই। আমার কণ্ঠ আমাকে শক্তি দিয়েছে, আলোর দিকে ফিরিয়েছে। কণ্ঠ আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।”

জাওয়াদ উর রাকিন খান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী, যার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় কণ্ঠের ছোঁয়ায় রঙিন হয়েছে। রাকিন বলেন, “ছোটবেলায় রেডিও শুনে ভাবতাম—ইশ! যদি এভাবে কথা বলতে পারতাম। আজ আমি বাংলাদেশ বেতার কুমিল্লা কেন্দ্রের ঘোষক ও উপস্থাপক—এই স্বপ্ন সত্যি করেছে আমার কণ্ঠ। কণ্ঠ আমায় দিয়েছে আত্মবিশ্বাস, গ্রহণযোগ্যতা, এমনকি পরিচয়ও।” এমন এক অভিজ্ঞতার কথাও বলেন তিনি, যা তাকে আজও হাসায়—’অনফিল্ড’ নামের এক ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে আমার ভয়েসওভার দেওয়া হয়েছিল। কিছু বন্ধু ভাবল, ভয়েস নিশ্চয় অন্য কারও—কারণ আমার কণ্ঠ তারা এভাবে চিনে না, অথচ সেই ভয়েসটা ছিল আমার নিজের।”

বাংলাদেশ বেতারের কন্ঠশিল্পী শিমুল চৌধুরী, যার কণ্ঠ অনেককেই ছুঁয়ে গেছে গভীরভাবে। তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, “আমি বলব না, আমার কণ্ঠ খুবই অসাধারণ। কিন্তু এটুকু জানি, আমার আবৃত্তি শুনে কেউ কেউ কেঁদেছে—আমার কণ্ঠ তাদের ভেতরের দুঃখ বের করে আনতে পেরেছে। কণ্ঠ শুধু আওয়াজ নয়, কখনও হয়ে ওঠে মুক্তি। কণ্ঠের মাধ্যমেই কবিতার গভীরতা বোঝানো যায়, প্রাণ পায় নিস্তরঙ্গ শব্দ।”

কণ্ঠ এমন এক প্রেরণা ও অনুরণন—যা মনের গভীর স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। কণ্ঠ কখনও গান, কখনও নাটক, কখনও প্রতিবাদের স্লোগান। শব্দের বাইরেও এই কণ্ঠ আমাদের আত্মার স্বাক্ষর।

আই/কিফায়াত উল হক

শেয়ার করুন -

আত্মার স্বাক্ষর কণ্ঠ